Loading...

সবার উপরে মানুষের জীবন: প্রধানমন্ত্রী

| Updated: May 14, 2021 14:59:16


সবার উপরে মানুষের জীবন: প্রধানমন্ত্রী

মানুষের জীবনের মূল্য যে সব থেকে বেশি, সেই কথাটি দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যে যেখানে আছেন, সেখানেই ঈদ উদযাপন করতে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর।

ঈদের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেছেন, উদযাপনের এই উপলক্ষ যেন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ না হয়ে ওঠে।

শেখ হাসিনা বলেন, “আপনারা আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ঈদের ছুটি কাটাতে যাবেন না। অনেকের কোনো বাহ্যিক লক্ষণ না থাকায় আপনি বুঝতে পারবেন না আপনার পাশের ব্যক্তিটিই করোনাভাইরাস বহন করছে।

“এর ফলে আপনি যেমন করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে পড়বেন, তেমনি আপনার নিকটাত্মীয় বা পাড়াপ্রতিবেশীকে ঝুঁকির মুখে ফেলবেন।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মনে রাখবেন, সবার উপরে মানুষের জীবন। বেঁচে থাকলে আসছে বছর আবার আমরা আনন্দঘন পরিবেশে ঈদ উদযাপন করতে পারব।”

করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এক মাস রোজা শেষে আরেকটি বিবর্ণ ঈদের সামনে বাংলাদেশ। মহামারীর বিধিনিষেধের মধ্যেই শুক্রবার দেশে ঈদুল ফিতর উদযাপন হতে যাচ্ছে।

গতবছরের মত এবারও রোজার ঈদ এসেছে লকডাউনের বিধিনিষেধের মধ্যে। ঈদগাহ বা খোলা জায়গার বদলে মসজিদে মসজিদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবং কাতারে দূরত্ব রেখে ঈদ জামাতের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। করোনাভাইরাস অতি ছোঁয়াচে বলে হাত মেলানো বা কোলাকুলিতেও মানা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব এক গভীর সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ নামের এক মারণব্যাধি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

“দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতাসম্পন্ন এই ভাইরাস একদিকে যেমন অগণিত মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষতিসাধন করছে মানুষের জীবন-জীবিকার। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং অর্থনীতির উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এই ভাইরাস।”

সরকারপ্রধান বলেন, গত বছরের শেষ দিকে যখন বিশ্বব্যাপী ভাইরাসের প্রকোপ অনেকটা কমতে শুরু করেছিল, তখন এই সঙ্কট থেকে মুক্তির আশা জাগতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ বছরের মার্চ থেকে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ সব পরিকল্পনা ও প্রত্যাশাকে ‘নস্যাৎ করে’ দিয়েছে। ‘কষ্ট হবে জেনেও’ সরকার মানুষের স্বাভাবিক চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে।

“এমনি এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে এবারও আমাদের ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে হচ্ছে। আমরা ঈদ উদযাপন করব, তবে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে। কোনোভাবেই এই ঈদ উদযাপন যাতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বৃদ্ধির উপলক্ষ হয়ে না ওঠে, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।”

যে যেখানে আছেন, সেখান থেকেই ঈদ আনন্দ উপভোগ করার অনুরোধ জানান প্রধানমন্ত্রী। সেইসঙ্গে এই দুঃসময়ে দরিদ্র প্রতিবেশী, গ্রামবাসী বা এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়াতে বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, “আপনার সাহায্য হয়ত একটি পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাবে। দেখবেন, তাদের হাসিমুখ আপনার হৃদয়মনকেও পরিপূর্ণ করে তুলবে ঈদের আনন্দে।”

কঠোর হওয়ার ‘বিকল্প ছিল না’

শেখ হাসিনা তার ভাষণে বলেন, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে না, বিশ্ব অর্থনীতিকেও বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ এড়াতেই লক-ডাউন বা সাধারণ ছুটি বলবৎ করতে হয়েছে।

গত বছর একটানা দুই মাসের বেশি সময় লকডাউন চলার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, “দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর গত মাসের ৫ তারিখ থেকে পর্যায়ক্রমে লক-ডাউন কার্যকর করা হয়েছে। এর ফলে অগণিত মানুষের রুটি-রুজির উপর আঘাত এসেছে। কিন্তু এই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।

“আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, প্রতিটি দেশেরই স্বাস্থ্য অবকাঠামোর একটি নির্দিষ্ট সক্ষমতা রয়েছে। হঠাৎ করে দ্রুতগতিতে রোগী বাড়তে থাকলে তখন সেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আপনারা দেখেছেন, উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত করোনা রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সেজন্য আমাদের কোনোভাবেই রোগীর সংখ্যা বাড়তে দেওয়া যাবে না।”

সরকার মানুষের জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বজায় রাখার ‘চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, তাদের সহায়তার জন্য সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।”

সবাই আসবে ‘টিকার আওতায়’

২০২১ সাল শুরু হয়েছিল টিকার আশা নিয়ে। বাংলাদেশ টিকা কেনার জন্য চুক্তি করেছিল গতবছরই, সেই টিকার প্রথম চালান হাতে পাওয়ার পর ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয় গণ টিকাদান।

কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ টিকা রপ্তানির উপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থায় ‘কিছুটা সমস্যা’ হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার বিকল্প উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের উদ্যোগও ইতোমধ্যে নিয়েছে।

“রাশিয়া এবং চীনের টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। উপহার হিসেবে চীনের কাছ থেকে টিকা ইতোমধ্যে আমরা পেয়েছি। আমরা টিকা পাওয়ার জন্য আমেরিকার কাছেও অনুরোধ জানিয়েছি। বিশ্ব টিকাকরণ সংস্থা কোভ্যাক্সের কাছ থেকেও আমরা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ টিকা পাব।

“বিভিন্ন উৎস থেকে আমরা এক কোটি টিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা নিয়েছি। খুব শিগগিরই দেশে টিকা আসতে শুরু করবে। তাছাড়া, দেশেই যাতে টিকা উৎপাদন করতে পারি, সে ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি। নিজেদের টিকা তৈরিতে কয়েক মাস সময় লাগবে। আমরা দেশের সকল নাগরিককে টিকার আওতায় নিয়ে আসব, ইনশাআল্লাহ।”

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিয়েছে জানিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও ভাষণে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, গত বছর মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজার ১৬৬ জন ডাক্তার, ৫ হাজার ৫৪ জন নার্স এবং প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জেলা হাসপাতালগুলোসহ দেশের ১৩০টি সরকারি হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে চালু হয়েছে ২ হাজার শয্যার কোভিড হাসপাতাল।

স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সশস্ত্রবাহিনীর সদস্য, প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ যারা ঝুঁকি নিয়ে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন, তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানান সরকার প্রধান।

রোনাভাইরাস প্রতিরোধে নাগরিকদের দায়িত্বেই সবচেয়ে বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্কের ব্যবহার অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কাজেই বাইরে গেলে অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করবেন। পাশাপাশি যথাসম্ভব ঘনঘন সাবানপানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন অথবা স্যানিটাইজার দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন।”

‘আশানুরুপ’ প্রবৃদ্ধির আশা

জনগণের ‘সহযোগিতায়’ এবং সরকারের ‘সময়োচিত কার্যক্রমে’ গত এক বছর করোনাভাইরাস মহামারীর আর্থিক অভিঘাত ‘খুব ভালোভাবেই’ সামাল দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী।

ভাষণে তিনি বলেন, “আমরা যখন প্রথম ঢেউ সামলে অর্থনীতিকে সাবেক অবস্থার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসার পর্যায়ে, তখনই মার্চ মাসে দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। এতে করে আমাদের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধিতে হয়ত খানিকটা ভাটা পড়বে।

“তবে আমাদের অভ্যন্তরীণ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার হিসেবে এবারও আমরা আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবো। গত সপ্তাহে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে।”

অর্থনীতিতে মহামারীর ধাক্কা সামলাতে গতবছর থেকে সরকার যসব উদ্যোগ নিয়েছে তার একটি বিবরণ প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে তুলে ধরেন।

# চলতি মাস পর্যন্ত মোট ১ লাখ ২৯ হাজার ৬১৩ কোটি টাকার সহায়তা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ২১টি খাতে মোট ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর অনুদান বাবদ ৮ হাজার ২৬০ কোটি টাকার বেশি বিতরণ করা হয়েছে।

# গত বছর সাময়িকভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া ৩৬ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে আড়াই হাজার টাকা করে মোট ৯১২ কোটি ৫০ লাখ দেওয়া হয়েছে। এ বছরও সমান মানুষকে একই হারে টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ত্রাণ মন্ত্রণালয় ৬০৭ কোটি টাকা বিতরণ করেছে।

# মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ৬৫ হাজার ৬৫৪টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৩ হাজার ৪৩৪টি ঘর নির্মাণের কাজ চলছে। বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত সরকার সাড়ে তিন লাখ পরিবারকে গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছে।

সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্যের শপথ

ভাষণের শুরুতেই দেশের জনগণ ও বিশ্ববাসীকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা সবাইকে ‘ঈদ মোবারক’ বলেন শেখ হাসিনা।

বক্তব্যের শেষে এসে আবারও সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের দিন আনন্দের দিন। মনের সব কালিমা দূর করে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যেই ঈদের আনন্দ।

“আজকের দিনে আমরা হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা, লোভ, অহমিকা, ক্রোধ, অহঙ্কার ইত্যাদি যাবতীয় কুপ্রবৃত্তি থেকে নিজেদের মুক্ত করে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার শপথ নেব।”

 

Share if you like

Filter By Topic