মালদ্বীপে ‘সুদিন ফিরছে’ বাংলাদেশিদের
এফই অনলাইন ডেস্ক | Sunday, 5 December 2021
ছোট্ট দ্বীপ দেশ মালদ্বীপের মুফাসির বিলাসবহুল রিসোর্টে মেইনটেন্যান্স সুপারভাইজার হিসেবে কাজ করতেন সাখাওয়াত হোসেন। কোভিডের প্রথম ধাক্কায় গত বছর বেশ বিপাকেই পড়তে হয় তাকে। পর্যটকের আগমন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাকরি হারিয়ে এ মালদ্বীপপ্রবাসীকে দেশে ফিরতে হয়।
প্রায় একবছর তিন মাস পর সাখাওয়াত আবার সেই রিসোর্ট থেকে ডাক পেয়েছেন। সেই ডাকে সাড়া দিয়েই তিনি উড়াল দেন মালদ্বীপের পথে; শুক্রবার তার সঙ্গে কথা হয় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজে।
ওই উড়োজাহাজে ছিলেন সাখাওয়াতের মতো আরও অন্তত ১০ জন, যারা কোভিড মহামারীর মধ্যে চাকরি হারিয়েছিলেন। মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে মালদ্বীপে আবার পর্যটক আসতে শুরু করায় তারাও নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ডাক পেয়ে ফিরছেন। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
২০২০ সালে মালদ্বীপে এক লাখ ৮০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক কর্মরত ছিলেন বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়। এই সংখ্যা বাস্তবে একলাখ ৪৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৩০ হাজারের মধ্যে ওঠানামা করে।
এসব শ্রমিকদের মধ্যে মধ্যে আবার অন্তত ৬৫ হাজার অবৈধভাবে কাজ করছে। এই অবৈধদের মধ্যে একটি বড় অংশ বাংলাদেশ থেকে আসা।
মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। তার মধ্যে কমপক্ষে এক লাখ বাংলাদেশি, যারা রাজধানী মালে, আশপাশের এলাকা ও দ্বীপ রিসোর্টগুলোতে কাজ করেন বলে এখানে অবস্থানরত শ্রমিকদের ভাষ্য।
মালদ্বীপের হোটেল, রিসোর্ট, কাপড়ের দোকান, চা-কফির দোকানগুলোর প্রায় প্রতিটিতেই অন্তত একজন করে বাংলাদেশি শ্রমিক পাওয়া গেল। ট্যাক্সি ও অন্যান্য গাড়িচালনা পেশাতেও নিয়োজিত আছেন অনেক বাংলাদেশি। গাড়ি মেরামত, ইলেকট্রিশিয়ান, কাঠমিস্ত্রি হিসেবেও কাজ করছেন অনেকে।
তবে মালদ্বীপে অভিবাসী শ্রমিকদের ভিসা নিয়োগকর্তার অধীনে দেওয়া হয় বলে তার অনিচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিলেই ওই কর্মী অবৈধ হয়ে পড়েন।
মালের বিমানবন্দরের নেমে হোটেলে ফেরার জন্য যে গাড়িটি ভাড়া করা হয়েছিল তার চালক বাদলের বাড়ি মৌলভীবাজারের শায়েস্তাগঞ্জে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বল্পশিক্ষিত বাদল বাংলা, হিন্দি দিবাহি (মালদ্বীপের ভাষা) ও তামিল ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। শিখে নিয়েছেন কাজ চালানোর মত ইংরেজিও।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, মহামারীর প্রথম ধাক্কাতেই তাকে দেশে ফিরতে হয়। পর্যটকরা আসতে শুরু করায় চার মাস আগে তিনি মালদ্বীপে পুরনো পেশায় ফিরতে পেরেছেন।
মালের কাপড়ের দোকানের কর্মী আরেক বাংলাদেশি কাউসার বলেন, মহামারীর শুরুতে চাকরি হারালেও তিনি দেশে ফেরেননি। কারণ তিনি বৈধভাবে কাজ করছিলেন না। তার শঙ্কা ছিল, একবার চলে গেলে আর ফিরতে পারবেন না। জমানো টাকা ভেঙে কিছুদিন কাটিয়েছেন। পরে কাপড়ের দোকানে কাজ করছেন।
চাঁদপুরের ছেলে শাকিব প্রিন্স কাজ করেন একটি কফি শপে। গেল বছর কোভিড হয়েছিল তার। প্রায় এক বছর বেকার ছিলেন, কিন্তু দেশে যাননি।
শাকিব বলেন, “একটা বছর যে কী কষ্ট করছি ভাই! গতবছর একটা ভালো রেস্টুরেন্টে কাজ করতাম। মহামারীর প্রথম দিকেই ওই রেস্টুরেন্টের সব স্টাফ আমরা আক্রান্ত হলাম। রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিলেন মালিক। শুরু হলো কষ্টের কাল। খেয়ে পড়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকারও যেন কোনো উপায় নেই।
“কোভিড থেকে সেরে উঠলাম। কিন্তু এখানে তখন কোনো কাজ নেই। দেশ থেকে টাকা আনার কোনো সুযোগ নেই। তখন মানুষের বাসাবাড়িতে হাউসকিপিংয়ের কাজ করেছি, রেস্টুরেন্টের রান্নাঘরে কাজ করে কোনো রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে গেছি। এখন বাজার ঘুরে গেছে; আবার কাজ পাওয়া যাচ্ছে।”
তাই আগামী মাসে দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন শাকিব।
ময়মনসিংহের ছেলে নাদিম দোকানে কাজ করেন। মহামারীর সময় তাদের দোকান মালিক অর্ধেক বেতন দিতেন; সঙ্গে খোরাকি। এখনো সে দোকানেই কাজ করছেন তিনি।
নাদিম বলেন, মহামারীর সময় তার আশপাশের অনেকেই দেশে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আবার একজন-দুজন করে ফিরে আসছেন।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কের হিসেব অনুযায়ী, গত বছরের ১ এপ্রিল থেকে ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ১৫ হাজার ৯৭৭ জন প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরেন। এদের মধ্যে ১১ হাজার ৪৩৬ জনের পাসপোর্ট ছিল। বাকি শ্রমিকদের বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তাদের ফিরিয়ে আনা হয় ‘আউটপাসের’ মাধ্যমে। এই শ্রমিকদের ফিরে আসার কারণ হিসেবে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের চার্টে বলা হয়, পর্যটকনির্ভর দেশ হওয়ায় কোভিডের কারণে কোনো কাজ নেই, তাই মালিক বা কোম্পানি ফেরত পাঠিয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পর্যটন নির্ভর মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা পাঁচ লাখের মতো, যার মধ্যে দুই লাখ অভিবাসী। এই অভিবাসীদের বড় অংশ বাংলাদেশি।
“ধরা হয়, এখানে এক লাখের বেশি বাংলাদেশি থাকেন। মহামারীর ধাক্কায় এদের অনেককে দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। এখন আবার তারা দেশটিতে ফিরতে শুরু করেছেন।”
মালদ্বীপের হুলহুমালে এলাকায় বাংলাদেশ মিশনের কাছেই লমুনেলি রেস্তোরাঁয় কয়েক বছর ধরে কাজ করেন কুমিল্লার মিলন হোসেন।
তিনি বলেন, যারা কোম্পানির হয়ে কাজ করছেন মহামারীর মধ্যেও তারা কর্মহীন হননি। কোম্পানিগুলো তাদের থাকা-খাওয়াবাবদ খরচ যুগিয়েছে। এখন আবার কাজের বাজার খুলছে।
“কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশের লোক নিচ্ছে না মালদ্বীপ। যার ফলে কোম্পানিগুলো মাসে ৩০০ ডলার বেতনেও লোক খুঁজে পাচ্ছে না। অন্য দেশ থেকে কর্মীরা আসছে।”
মিলন বলেন, টুরিস্ট ভিসায় এসে যারা কাজ করছেন, তাদের বৈধ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। পাসপোর্ট নিয়ে কেউ কোনো কোম্পানির কর্মী হিসেবে আবেদন করলেই মালদ্বীপ সরকার তাদের বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে। এসব কর্মী বৈধতার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছে।
বাংলাদেশ মিশন আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে পারলে বাংলাদেশ থেকে কর্মীদের বৈধভাবে মালদ্বীপে আসার সুযোগ তৈরি হবে বলে তিনি মনে করেন।
মিলন বলেন বলেন, “আমরা শুনছি, প্রধানমন্ত্রী মালদ্বীপে আসবেন। আমরা আলাপ করি প্রতিদিন, প্রধানমন্ত্রী এসে যেন শ্রমবাজার আরও বিস্তারের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। কারণ এখানে শ্রমিকেরা যে আয় করতে পারেন অন্য অনেক দেশেই তা সম্ভব নয়।”
মহামারীর মধ্যেও গত দুই বছরে তিনি ১০ লাখ টাকা দেশে পাঠিয়েছেন বলে জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মালদ্বীপ থেকে বৈধ পথে প্রবাসীরা ২ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার ডলার দেশে পাঠান, যা পরের অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবাসী আয় এসেছে ৪ কোটি ৪৭ লাখ ৪০ হাজার ডলার। আর গত অর্থবছরে তা সামান্য বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার হয়েছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ শরিফুল বলেন, মালদ্বীপে বাংলাদেশি শ্রমিকদের একটা বড় অংশ টুরিস্ট ভিসায় অবৈধভাবে কাজ করেন। একারণে তার বেতন-ভাতাসহ সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত হন। তাদের বৈধ করার পাশাপাশি নতুন অভিবাসী শ্রমিক যাওয়ার বিষয়েও সরকারের দ্রুত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে গত ১৭ মার্চ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ।
মালদ্বীপের ডাক্তার ও নার্সের চাহিদা মেটানোর জন্য সেদেশে বাংলাদেশি ডাক্তার ও নার্স পাঠানোর অনুরোধ করে গেছেন তিনি। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মালদ্বীপে অনিয়মিত শ্রমিকদের দ্রুত নিয়মিতকরণের অনুরোধ করেন।
শ্রমিকদের আসা যাওয়া বাড়ার কারণে দেশটিতে নতুন রুট খুলছে এয়ারলাইন্সগুলোও। গত ১৯ নভেম্বর ঢাকা থেকে মালে রুটে ফ্লাইট চালু করে ইউএস-বাংলা।
ওই ফ্লাইটের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, এতোদিন ঢাকা থেকে একবার (ওয়ানওয়ে) মালদ্বীপে যেতে ভাড়া গুণতে হতো ৬৫ হাজার টাকা। ইউএস বাংলার সরাসরি ফ্লাইট প্রায় অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে
Editor : Shamsul Huq Zahid
Published by Syed Manzur Elahi for International Publications Limited from Tropicana Tower (4th floor), 45, Topkhana Road, GPO Box : 2526 Dhaka- 1000 and printed by him from City Publishing House Ltd., 1 RK Mission Road, Dhaka-1000.
Telephone : PABX : 9553550 (Hunting), 9513814, 7172017 and 7172012 Fax : 880-2-9567049
Email : [email protected], [email protected]