logo

পর্যটকের পকেট কাটা ও অপয়া পর্যটন 

জিমি আমির | Saturday, 6 March 2021


কাজের চাপ কিংবা পারিবারিক, সামাজিক বা আশপাশের নানান ঝামেলা থেকে বাঁচতে দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও কখনো কখনো দেমাগ ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। যাতায়াতের সমস্যা তো আছেই। তার ওপর যদি অনেক আগে হোটেল বুক করে রাখতে না পারেন তো তিনগুণ ভাড়ায় হোটেলে থাকতে হবে। সে টিনের চালাই হোক আর টেন্ট’ই হোক। খাবারে হাত দেবেন তো মনে হবে হাত পুড়ে গেল। আর বের হতে গেলে তো আপনি পরিবহন খাতের ‘জুতসই মুরগি’।

বাবা মাকে নিয়ে কয়েক দিন আগে দুই দিনের জন্য গিয়েছিলাম সেন্ট মার্টিন। আগেই একটা রিসোর্ট বুক করা থাকলেও টাকা দেওয়া হয়নি বলে সেটা তারা নিজ উদ্যোগে আরেকজনকে দিয়ে দিয়েছে। যাওয়ার আগে আরেকটা থাকার জায়গা ঠিক করতে গিয়ে যে হ্যাপা, তাতে মনে হলো এর চেয়ে না যাওয়াই ভালো।

টেকনাফে ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ার পর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কি দেখবেন। কোথায় থাকব? কতক্ষণ লাগবে ঘুরতে? একদিন তো এখানেই শেষ। এই সব ভাবতে ভাবতে দিনের অর্ধেকেই মন-মেজাজের অবস্থা কাহিল।

ঘাট থেকে নেমে ভাবলাম একটা ভ্যান নিই। আব্বা-আম্মা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। প্রথমত অনেক দূর পর্যন্ত মানুষের মাথা ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। তো ওই অবস্থায় মিনিট দশেক হাঁটার পর একটা ভ্যানে চড়ে রিসোর্ট নামের একটি ঘরে পৌঁছলাম আর কি।

টিনশেডের ছোট্ট একটি ঘরে দুটো খাট পাওয়া গেল। এক হাজার টাকার সেই ঘর বহু জোরাজুরির পর নিতে হলো সাড়ে চার হাজার টাকায়। বাবা মা নিয়ে গেছি বলে এই দুঃখ গিলে ফেললাম।

এবার তাহলে সৈকতের দিকে যাওয়া যাক। সেন্ট মার্টিনে গিয়ে ডাবের পানির পিপাসা পাবেই। সে ডাব তো ৭০ টাকার নিচে খাওয়াই যাবে না। যে সাইজেরই হোক না কেন? দামাদামির কোনো বালাই নেই। তাড়াহুড়োয় শ্যাম্পু নিতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে কয়েকটা প্যাকেট নিলাম। দোকানিকে দাম দিয়ে চলে আসছি, এমন সময় দোকানি বললেন, ‘আরও দেন’। বললাম, ‘কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমার লাভ আছে না!’

যেহেতু মাছের এলাকায় গেছেন তো মাছ খেতেই হবে। সঙ্গে যদি ডাল বা ভর্তা নেন তাহলে তো রীতিমতো শাস্তি। ধরেন জনপ্রতি এক চামচ করে ডাল নিলে আমাদের চার চামচ ডালে দিতে হলো ৫০ টাকা। ভাত কতটুকু খাবেন সেই হিসেব না করলেও খাওয়া শেষে প্রতি প্লেটে দিতে হবে ৪০ টাকা। মাছের হিসেব আর বলতে ইচ্ছে করছে না!

ঢাকায় কোরাল ৩শ টাকাতেই এক কেজি পাওয়া যায়। তো ওখানে সাগরের পাড়ে বসে বারবিকিউ খেতে চাইলে আপনাকে গুনতে হবে সর্বনিম্ন ৮ শ টাকা। অবশ্য সঙ্গে দুটি ছোট সাইজের পরোটা পাবেন।

সকালে ছেঁড়া দ্বীপে যাওয়ার জন্য বের হতে গিয়ে সে এক বিড়ম্বনা। আগের রাতে জানা গিয়েছিল প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল পরিবেশের ওপর হুমকির কারণে সেখানে না যাওয়ার জন্য। ফলস্বরূপ প্রশাসনের বিরুদ্ধে উল্টো দ্বীপের ‘লোভী’ ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটে নেমেছেন। শেষে প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বাধ্য হয়।

একটু ঝামেলাবিহীন সময় কাটানোর জন্য কোথাও বের হয়ে যদি এত চিন্তা করতে হয় তাহলে তো ঢাকার পার্কে বসে বাদাম খাওয়াই ভালো। কেউ জিজ্ঞেস করতে পারেন ভাই, টাকা নাই তো ঘুরতে যাওয়ার শখ হয় কেন? আরে ভাই নিজের দেশে ঘুরতে গেলেও কি এত খরচের হিসেব মাথায় নিতে হবে? আর বেড়াতে গেলেই টাকার বান্ডিল নিয়ে কেন যেতে হবে, কেনই বা অযৌক্তিকভাবে বেশি দিতে হবে? এটা কেমনতর কথা?

সাধারণত, কোনো এলাকায় বড় প্রকল্প বা স্থাপনা তৈরি হলে সেই এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। এমনকি সরকারও সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। সেইভাবে পর্যটন কেন্দ্রিক অঞ্চলেরও সেইভাবে উন্নয়ন ঘটবে তাই স্বাভাবিক। ১০ টাকার জায়গায় ২০ বা ২৫ টাকা খরচ করা যায়। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি পাঁচ ছয় গুণ লাভ করতে চান তাহলে তাকে কী বলা যাবে? পর্যটকদের জন্য কোনো সুবিধা আছে যে এই সুখে তারা শুধু টাকাই ঢালবে? না কোনো নিরাপত্তা, না কোনো গাইড। মজা করতে গিয়ে উল্টো ভয়ে ঘরে বসে থাকতে হয়।

২০১৯ সালের এক হিসেবে মার্কিন উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কম্প্রিহেনসিভ প্রাইভেট সেক্টর অ্যাসেসমেন্ট (সিপিএসএ) জানিয়েছিল, বাংলাদেশে পর্যটন কেন্দ্র ভ্রমণের উদ্দেশ্য নিয়ে আসে বিদেশিদের মাত্র পাঁচ শতাংশ।

প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশ ভ্রমণে আসা বিদেশি নাগরিকদের সবচেয়ে বড় অংশই আসে তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়িক প্রতিনিধি হিসেবে। এ ছাড়া উন্নয়ন খাতের বিভিন্ন কাজ তদারকিতে আসা বিদেশিরা এখানে বেড়িয়ে যান। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট ও বিভিন্ন দূতাবাস সংশ্লিষ্টরা রয়েছেন।

শুধু পাশের দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখা যায়, সহজ সেবা, কম খরচের জন্য এ দেশের প্রচুর মানুষ সেখানে যাচ্ছে। কম খরচে ভালো সেবা পাওয়া যায় বলে শুধু চিকিৎসার জন্যই কয়েক লাখ মানুষ প্রতিবছর ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে।

তাই, সবদিক বিবেচনায় বাংলাদেশেও শর্ত একটাই হওয়া উচিত! অত্যন্ত কম খরচে ‘বাজেট টুরিজমের’ সেবা দিতে হবে এখানে। দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষকে কম খরচে রুম ভাড়া, কম খরচে খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, কম খরচে আসা-যাওয়া—এই সব সুবিধা দিতে হবে। পর্যটন মানেই গলাকাটা খরচ নয়, সেই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে দেশের পর্যটন অঞ্চলে।

জিমি আমির উন্নয়ন কর্মী, ফ্রিল্যান্স লেখক

jimiamir 16 @gmail. com