আমাদের সবার মনে প্রায়ই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, আর সেটি হলো, একটি দেশের হাতে টাকা ছাপানোর সম্পূর্ণ অধিকার থাকা সত্ত্বেও সেই দেশ ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায় না কেন? অথবা পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, বা টানেল নির্মাণসহ দেশের যেসব বড় বড় স্থাপনাগুলো রয়েছে, সেগুলোতে অর্থসংস্থানের সময় সরকারকে কেনই বা এত সংস্থার কাছে যেতে হয়, যেখানে সরকারের কাছেই রয়েছে টাকা ছাপানোর মেশিন?
এরই পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের হয়তো মনে পড়তে পারে ‘লা কাসা দে পাপেল’নামক একটি স্প্যানিশ টিভি সিরিজের কথা যেখানে এক দল ডাকাত একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে ঢুকে ইচ্ছেমতো টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, তারা ব্যাংকটিতে ঢুকে টাকা লুট না করে টাকা ছাপানোর মেশিন দিয়ে ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে নিয়ে যায়। তাহলে কোনো দেশের ক্ষেত্রে সরকার এমন করে টাকা ছাপালে সমস্যা কোথায়? তবে বিষয়টিকে আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু বিষয়টি অনেক জটিল।
যেকোনো দেশে টাকা ছাপানোর ক্ষমতা সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকলেও এটি তার যত ইচ্ছা তত টাকা ছাপায় না। অনেক হিসেব-নিকেশ এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে টাকা ছাপাতে হয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বোঝা যাক। ধরুন, একটি দেশ বছরে ১০০০ টাকা করে ছাপায় এবং সে দেশে চালের কেজি ৫০ টাকা করে। তাহলে ঐ ১০০০ টাকা দিয়ে মোট ২০ কেজি চাল কেনা সম্ভব। এখন যদি চালের উৎপাদন একই রেখে ঐ দেশ বছরে ২০০০ টাকা করে ছাপায়, তাহলে চালের কেজি প্রতি দাম বেড়ে হবে ১০০ টাকা, যা মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করবে। আর আমরা জানি, মুদ্রাস্ফীতির ফলে অর্থের মূল্য কমে যায়, যা একটি দেশের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।
অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, এতে সঞ্চয়ের মান কমে যায়। কারণ আপনি যদি আজকে কোনো ব্যাংকে হিসাব খুলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকা জমা রাখেন অথবা সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন, তাহলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে আপনি আসল টাকাসহ কিছু মুনাফা পাবেন। অথচ অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণে দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হলো, তার কারণে আপনি দেখতে পেলেন, ব্যাংক বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আপনি মুনাফাসহ যে অর্থ পেয়েছেন, তা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যই কিনতে পারছেন না। আর এর ফলে যেকোনো ব্যক্তিই সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হবে। ফলে, ব্যাংকের আমানত এবং সরকারি অর্থসংস্থান দু’টিই মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।
আবার ধরা যাক, সরকার কোনো দেশ থেকে ঋণ করল। পরে যখন ঋণের অর্থ পরিশোধের সময় আসবে, তখন ঐ দেশ উক্ত পরিমাণ টাকা ছাপিয়ে ঋণ পরিশোধ করে দিল। তবে বিষয়টি কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাবে না। কারণ, আমদানি-রপ্তানি বা বিদেশি কোন ব্যবসায়িক প্রয়োজন মেটাতে গেলে সেটির অর্থ নিজ দেশের মুদ্রার সাহায্যে পরিশোধ করতে হয়। তাই দেখা যাবে, বিদেশিদের কাছে পরিশোধিত অর্থ আবার ঘুরেফিরে নিজ দেশেই ফেরত আসবে, যা একসময় মুদ্রাস্ফীতির জন্ম দেবে।
অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণে অনেক দেশকেই সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। জিম্বাবুয়ের নাম এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটিতে ২০০৫ সালের নির্বাচনে রবার্ট মুগাবে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানো শুরু করে। আর এটি সে দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। যেখানে ২০০৬ সালে একজন জিম্বাবুইয়ান নাগরিক মাসে ২০২ মার্কিন ডলার আয় করত, যার মূল্য ছিল জিম্বাবুয়ের মুদ্রায় ১৭ হাজার ২০০ ডলার, তা ২০০৮ সালে গিয়ে দাঁড়ায় মাসে ৪১ মার্কিন ডলার। অথচ জিম্বাবুয়ের মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
২০১০ সালে দেশটিতে দৈনিক মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ১৫৭ শতাংশ, যার অর্থ, আজকে যদি কোনো দ্রব্যের দাম ১০০ টাকা হয়, সেটি আগামীকাল হবে ২৫৭ টাকা। ২০১৫ সালের দিকে জিম্বাবুয়েতে ১ মার্কিন ডলারে ৩৫ লাখ কোটি জিম্বাবুইয়ান ডলার পাওয়া যেত। অথচ তা দিয়ে এক কাপ চাও পাওয়া যেত না। একসময় পরিস্থিতি এমন হয় যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের হাজার হাজার কাগজি নোট রাস্তার পাশে পড়ে থাকত। আর এর ফলে দেশটির অর্থনীতি চরম মাত্রায় ভেঙে পড়ে এবং বেকারত্ব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
আর এসব সমস্যার কথা মাথায় নিয়ে একটি দেশ যত্ ইচ্ছা তত টাকা ছাপায় না। বরং সকল দেশই চেষ্টা করে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। কারণ উৎপাদন বাড়লে একদিকে যেমন বেকারত্ব হ্রাস পাবে, অন্যদিকে এসময় কিছু অতিরিক্ত অর্থ ছাপালেও তা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করবে না। আর এতে করে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। তাই যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক গবেষণা করে টাকা ছাপায়। সাধারণত মোট জিডিপির ২-৩ শতাংশ হারে টাকা ছাপায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে এ হার কিছুটা কম-বেশি হতে পারে।
সাধারণত যেকোনো দেশ তাদের মোট জিডিপির উপর ভিত্তি করে অর্থের মোট চাহিদা এবং যোগান নির্ধারণ করে এবং সে মোতাবেক টাকা ছাপায়। অন্যথায় মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যুগে যুগে সব অর্থনীতিবিদও এই একই কথা বলেছেন। এ বিষয়ে ১৮৯০ সালে আলফ্রেড মার্শাল রচিত ‘অর্থনীতির কার্যকরণ’বইটিতেও একথা বলা হয়েছে। সেখানে তিনি এমন একটি সাম্যাবস্থার খোঁজ করতে থাকেন, যেখানে চাহিদা ও যোগান রেখা দু’টি মিলিত হবে। কারণ চাহিদা ও যোগান রেখা যেখানে মিলিত হয়, সেখানেই মূলত ভারসাম্য অর্জিত হয়। আর যেকোনো দেশে টাকা ছাপানোর ক্ষেত্রেও একথা প্রচলিত। কারণ, উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে যখন অতিরিক্ত অর্থের চাহিদা সৃষ্টি হয়, তখনই যেকোনো দেশের কেন্দ্রীয় ঐ চাহিদার উপর ভিত্তি করে টাকা ছাপিয়ে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দিয়ে থাকে।
তানজিম হাসান পাটোয়ারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন।