Loading...

বাবাক তাফরেশি ও রাতের আকাশ বাঁচাও

| Updated: July 31, 2021 21:46:19


বাবাক তাফরেশি- ছবি: সৈয়দ মূসা রেজা বাবাক তাফরেশি- ছবি: সৈয়দ মূসা রেজা

১৯৯৫ সাল।

সে বছর মহাজাগতিক দু’টো ঘটনা ১৬ বা ১৭ বছর বয়সী এক ইরানি কিশোরের গোটা জীবনকে বদলে দেয়। এই দুই ঘটনার একট হলো পূর্ণ সূর্য গ্রহণ। অপরটি, রাতের আকাশে একটি ধূমকেতুর উদয়।

এই কিশোরের পুরো নাম বাবাক আমিন তাফরেশি। তবে সারা দুনিয়ায় তিনি বাবাক তাফরেশি নামেই পরিচিত। রাতের আকাশের ছবি তুলে এবং রাতের আসমানকে কৃত্রিম আলোর দূষণ থেকে রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে আজ বিশ্বজুড়ে সুনামের শীর্ষে রয়েছেন তিনি। বর্তমানে আমেরিকার বোস্টনে বসবাস করছেন। আলোকচিত্রীশিল্পীর মর্যাদায় মার্কিন খ্যাতনামা সাময়িকী ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। দ্যা ওয়ার্ল্ড অ্যাট নাইট স্কাই বা সংক্ষেপে টোয়ান নামের সংস্থার পরিচালক এবং প্রতিষ্ঠাতা

২০১৮ সালের কথা। তেহরানের আমির কবির প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রোফটোগ্রাফি বা জ্যোতি-র্আলোকচিত্র শিবিরে বাবাকের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়। দুবছর পর দ্বিতীয়বার আলাপ হল ২০২০ সালে। প্রতি দু’বছর পরপর তেহরানে আসেন। কয়েকটি অ্যাস্ট্রো-ফটোগ্রাফি বা জ্যোতি-র্আলোকচিত্র শিবির পরিচালনা করেন এ অবসরে। প্রতি শিবিরে পাঁচশো থেকে সাড়ে পাঁচশো অংশগ্রহণকারী থাকে। নাইকন স্কুল আয়োজিত এ কর্মশিবিরে যোগ দেওয়ার জন্য আগেভাগে নাম নিবন্ধন করাতে হলেও কোনও টাকাকড়ি দিতে হয় না। তবে নাম লেখাতে দেরি করলে সুযোগ নাও মিলতে পারে। এতে অংশগ্রহণকারীদের বিরাট অংশই ছাত্র-ছাত্রী।  তবে এ ছাড়া থাকেন জ্যোতি-র্আলোকচিত্রের ভক্ত নানা বয়সের নর-নারী। প্রতিবারই আমি ও আমার ছেলেরা বাবাকের মেহমান হিসেবে কর্মশিবিরে বসার সুযোগ পেয়েছি।

জীবনের মোড় বদলে দেওয়া ঘটনা দুটোর কথা বলতে গিয়ে বাবাক আমাকে বলেন, ‘পূর্ণ সূর্যগ্রহণ ইরান থেকে শুরু হয়ে এটি ভারতের দিকে যায়। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র  ১৫ সেকেণ্ড। তা সত্ত্বেও আমার ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।’

এই মহাজাগতিক ঘটনাটকে কেন্দ্র করে বিজ্ঞান সাংবাদিকতায় জগতে ঢুকলেন বাবাক। ইরানের নজুম বা জ্যোতির্বিদ্যা নামের মাসিক পত্রিকার সঙ্গে কাজ করতে থাকেন। জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত মধ্যপ্রাচ্যের পুরান পত্রিকা হল নজুম।  একই সঙ্গে ইরানের টেলিভিশনে মহাকাশ ও জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে অনুষ্ঠান করতে থাকেন তিনি। বাবাক  বলেন, ‘পাশাপাশি আলোকচিত্রের কাজও করতে থাকি।’

এই কাজের মধ্য দিয়ে রাতের আকাশের প্রতি টান বাড়তে থাকে। ১৩ বছর বয়সে প্রতিবেশির দূরবীণ এক রাতের জন্য ধারে এনে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে রাতের আকাশের রূপমুগ্ধ হয়ে ওঠেন - সে কথাও এর আগে বলেন বাবাক। তবে এও বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে খুব ছোটবেলা থেকেই আমিই রাতের আকাশ দেখে মজা পেয়েছি এবং রাতের আকাশ আমাকে টেনেছে। মনে হয়, রাতের আকাশের প্রতি টান নিয়েই জন্মেছি আমি।’ চাঁদে বা নিশিতে পাওয়া মানুষের কথা আমরা জানি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাবাক তাফরেশির আরও একধাপ বেশি। তাকে পেয়েছে, কেবল চাঁদ বা নিশি নয়, চাঁদ-তারকা-নক্ষত্রসহ রাতের সমগ্র আসমান।  কেবল ছবিই তুলছেন না বরং রাতের আকাশের নক্ষত্রখচিত অপরূপ সৌন্দর্য রক্ষার এক অগ্রযোদ্ধা হয়ে উঠেছেন এই বিদগ্ধ আলোকচিত্রশিল্পী।

রাতের আকাশের ছবি তুলতে যেয়ে পুলিশে হাতে পড়েছেন। অল্প সময়ের জন্য হাজতবাস হয়েছে। তাকে এমন বেগতিক পরিস্থিতির শিকার প্রায় সব দেশেই হতে হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর নির্দেশে রাতে তোলা ছবি মুছে দিতে হয়েছে। এ সব ঘটনা আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘রাতের আকাশের ছবি তোলার সঙ্গে জড়িত বিপদ এটা। এ বিপদ মেনে নিয়েই ছবি তুলতে হবে।’ মজার ভঙ্গিতে তিনি এ কথা ব্যক্ত করতেই কর্মশিবিরের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে হাসির ঢেউ ওঠে। 

রাত দুনিয়াকে ঢেকে দেয় কিন্তু মহাবিশ্বকে উন্মোচিত করে: পৃথিবীর রাতের আকাশ প্রতি বছর দুই শতাংশ হারে হারিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ অনাকাঙ্খিত আলোর দূষণের অসহায় শিকার হচ্ছে লক্ষ কোটি বছরের পুরানো নক্ষত্রলোকের অতুলনীয় সৌন্দর্য। আলোকমালা কখন দূষণ হয়ে ওঠে সে কথা বলতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক-স্কাই অ্যাসোসিয়েশন বলছে, কৃত্রিম আলোর মাত্রাতিরিক্ত বা অযৌক্তিক ব্যবহারই হচ্ছে দূষণ। আলোকের ঝর্ণাধরা নিয়ে আমরা মনোহর যতই গান করি বা সুর তুলি না কেন উপচে পড়া অনাকাঙ্খিত আলোকতরঙ্গ মমতাময়ী ঝর্ণাধারা না হয়ে ধ্বংসের সুনামিতে পরিণত হয়।  আগ্রাসী আলোকের এমন প্লাবন সৌন্দর্য হরণ করছে। বিপাকে ফেলছে মানুষের জৈবরাসায়নিক ছন্দকে। প্রাকৃতিক আলোর বাড়াকমাকে কেন্দ্র করে এ ছন্দের নিয়ন্ত্রণ চলে। কিন্তু আলোক-দূষণ পুরো ব্যবস্থাকে বেতাল বানিয়ে দেয়। পাশাপাশি এ প্লাবন  নিশিজীবী প্রাণিকুলকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে।

বাবাক বলেন, ‘আমাদের প্রকৃতির ৫০ ভাগই হলো রাতের আকাশ। সে দিক  থেকে হিসাব করলে এর অনেক  বড় ভূমিকা রয়েছে। কেবলমাত্র বিজ্ঞানী নয় বরং পৃথিবীর সবার সঙ্গেই রাতের আকাশে যোগসূত্র রয়েছে। রাতের আকাশের সঙ্গে সবাই অবাধে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। অবশ্য কতোটা আলো আমরা তৈরি করছি তার দ্বারা এর সঙ্গে যোগসূত্রের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। ‘

রাতের আকাশ রক্ষায় আলোকচিত্রের ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মানুষের কাছে রাতের আকাশের বার্তাকে আমার আলোকচিত্রের মধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। আর এর মাধ্যমে এমন একটি পেশার সূচনা হলো যাকে বিশ্বব্যাপী প্রকল্পে রূপান্তর করা হয়েছে। এটা হলো 'দ্যা ওয়ার্ল্ড অ্যাট নাইট'  বা রাতের বিশ্ব অর্থাৎ টিডব্লিএএন।  রাতের আকাশের প্রতি আগ্রহী, রাতের আকাশ রক্ষায় ত্যাগী মনোভাব সম্পন্ন এবং রাতের আকাশ রক্ষার লক্ষ্য রয়েছে এমন সব আলোকচিত্রী এর অন্তর্ভূক্ত হয়েছেন। তাদের একটি টিমে পরিণত করা হয়েছে।

গত বছর আলাপকালে বাবাক বলেন, তবে বিশ্বে আলোকদূষণ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে। আলোকদূষণ নিয়ন্ত্রণ করাটা খরুচে কোনও কর্মপন্থা নয়। বরং এতে আলোকের অপব্যবহার ঠেকাবে, খরচ কমবে। আলোকমালা যেন নির্ধারিত কাজের বাইরে ছড়িয়ে না পড়ে সে ব্যবস্থা করাটাও কঠিন কোনও প্রযুক্তি-চ্যালেঞ্জ নয়। 

নিশি উদ্যান: পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রচুর স্থান আছে সেখান থেকে রাতের আকাশ নির্বিবাদে দেখা যায়। এ ছাড়া, ইরানসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এমন স্থানগুলোকে রাতের আকাশ দেখার জন্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এ স্থানগুলোকে 'ডার্ক স্কাই পার্ক' 'রাতের আকাশের পার্ক' কিংবা সহজ ভাবে ‘নিশি উদ্যান’ বলা হয়। এ ধরণের পার্ক করার চিন্তা মাত্র এক দশকের কিছু বেশি সময় আগে শুরু হয়েছে। এ ধারণার প্রসার ঘটিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ডার্ক স্কাই অ্যাসোসিয়েশন। এখন এ ধারণা দেশে দেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। 

এখানে উল্লেখ্য, আলোকের আগ্রাসী দূষণ বাড়লেও এখনও ‘নিশি উদ্যানের’ ধারণার কুড়ি গজায়নি বাংলাদেশে । নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দেশের পার্বত্যভূমি, নদীর চর বা সাগর দ্বীপে এ জাতীয় উদ্যান গড়া যেতেই পারে।

রাতের আকাশের ছবি তোলার কথা বলতে গিয়ে বাবাক বলেন, এ কাজে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, এমন স্থান খুঁজে বের করা যেখানে মানুষের তৈরি আলোর কোনও দূষণ নেই।

রাতের আকাশে ছবি তোলার আরেক চ্যালেঞ্জ ক্যামেরা এবং যন্ত্রপাতি। সে কথাও জানান বাবাক। আজকের দিনের যে কোনও ডিএসএলআর বা আধা-পেশাদারি মিররলেস ক্যামেরা দিয়ে রাতের আকাশের ছবি তোলা যাবে। লং এক্সপোজার বা দীর্ঘ মেয়াদি এক্সপোজার করা সম্ভব কিন্তু এতে 'নয়েজ' নামে পরিচিত কিছু সমস্যা থাকবে না তেমন যে কোনও ক্যামেরা দিয়ে রাতের আকাশের ছবি তোলা যাবে। জানান তিনি।

রাতের আকাশের ছবি তোলার জন্য ১০ থেকে ৩০ সেকেন্ড এক্সপোজার দেয়া লাগবে এবং আইএসও থাকবে ৩২০০ থেকে ৬৪০০। এ ছাড়া ওয়াইড অ্যাংগেল লেন্স লাগবে। অল্প সময়ে সঠিক মাত্রার আলো ধারণের জন্য লেন্সকে ফাস্ট বা দ্রুত হতে হবে। অর্থাৎ ওপেন অ্যাপারচার ২.৮ বা তার চেয়ে কম হতে হবে। ক্যামেরা যাতে কোনোভাবে নড়াচড়া না করে সেজন্য শক্ত-সমর্থ ট্রাইপড বা তেপায়ার ওপর রাখতে হবে। অন্ধকার রাতকে সঠিকভাবে পাওয়া গেলে ছবি তোলার জন্য দামী ক্যামেরার প্রয়োজন নেই। রাতের আকাশের ছবি মানেই কেবল ছায়াপথের ছবি নয়। জানান তিনি। ছায়াপথের অসংখ্য ছবি তোলা হয়েছে। তাই ছায়াপথের ছবি তুলতে গেলে সতর্ক হওয়া দরকার।

বাবাক আরো বলেন, ‘আমার তোলা প্রতিটি ছবির একটি নিজস্ব গল্প আছে। আর তাই আমার কাছে হাজার হাজার আলাদা গল্প রয়েছে। রাতে অনেক কিছুই ঘটে। দিনের বেলায় এ সব ঘটনা সচরাচর ঘটে না। দিনের বেলায় মস্তিষ্ক যতোটা তৎপর থাকে রাতের বেলায় তা থাকে না। তাই রাতে আপনি ভুল করেন, কোনও কিছু আপনি পরিষ্কার ভাবে দেখতে পান না। এ ছাড়া দুর্ঘটনাও কখনও কখনও ঘটে। সব মিলিয়ে ছবি তোলাই হয়ত আর হয় না। রাতের আকাশের ছবি তোলার দিকে মানুষকে আকর্ষণ করার অন্যতম কারণ হলো এই যে দিনের আলোতে ছবি তোলার চেয়েও কাজের সঙ্গে এর মিল নেই, এটি একেবারেই ভিন্ন।’

বাবাক ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘রাতে নিজ চোখে আপনি যে আলো দেখতে পান না ক্যামেরা তা দেখতে পায় এবং ধারণ করে। রাতের বেলায় সবই আপনার কাছে অন্ধকার এবং বর্ণহীন ঠেকে। কিন্তু ক্যামেরা ৩০ সেকেন্ড এক্সপোজারের মাধ্যমে যে দৃশ্য ধারণ করে তা দেখে আপনি হতবাক হয়ে যাবেন।’

[email protected]

 

Share if you like

Filter By Topic