“পুরো পৃথিবী একদিকে আর আমি অন্যদিক/ সবাই বলে করছো ভুল, আর তোরা বলিস ঠিক”কিংবা “এক হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে সকাল বিকেল বেলা/ কত পুরনো-নতুন পরিচিত গান গাইতাম খুলে গলা”— মেজাজ ভিন্ন হলেও এই গান দুটোর প্রাণকেন্দ্রে আছে বন্ধু। সন্ধ্যার কফি অথবা গলা ছেড়ে গান, কিংবা কাছের মানুষটির তিরস্কারে জীবনে নেমে আসা পিনপতন নীরবতায় হঠাৎ হট্টগোল, দুঃখ ভোলার কারিগর যেন বন্ধুরাই। জানি, দিবস দিয়ে যায় না ওদের মাপা। তবু, বছর ঘুরে ক্যালেন্ডারে বন্ধুর জন্য থাকা দিনটি কমবেশি সবাই আমরা উদযাপন করি।
বন্ধু দিবসের শুরুর গল্প নিয়ে, পৃথিবীতে নানাবিধ কথা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করে, ১৯১৯ সালে হলমার্ক কার্ডের প্রতিষ্ঠাতা জয়েস হলের হাত ধরে বন্ধু দিবসের সূচনা ঘটে, আবার ইতিহাস খুঁড়লে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালে আমেরিকান সরকারের প্ররোচনায় আগস্টের প্রথম শনিবার এক বন্ধুর নির্মম মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে, আরেক বন্ধুর আত্ম বিয়োগের ঘটনা সূত্রে পরদিন রোববার বন্ধু দিবসের প্রারম্ভ হয়। পরবর্তীতে ২০১১ সালে জাতিসংঘ ৩০ জুলাই ‘বন্ধু দিবস’ ঘোষণা করলেও, ভারত কিংবা বাংলাদেশে আগস্টের প্রথম রোববারে দিবসটি এখনো পালিত হয়। ক’দিন আগেই চলে গেল ২০২১ সালের বন্ধু দিবস; তারিখ- ১লা আগস্ট।
কোভিডকালে যেহেতু স্বাভাবিক চলাফেরায় বদলে গেছে পথ, সেহেতু আমাদের আগেকার সে বন্ধু বন্ধু আমেজেও খানিকটা ভাটা পড়াই সত্য। তাও বন্ধুর খবর জানতে, স্মৃতির দরজা জানালা খুলে দিতে আমরা গিয়েছিলাম কিছু মানুষের কাছে। এ লেখায় জানব তাদেরই সেসব অনুভূতির কথা, যা তারা এবারের বন্ধু দিবসের পূর্বে ভাগ করে নিয়েছিলেন আমাদের সাথে।
প্রথমেই গিয়েছিলাম লন্ডনের কনভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়া পারভীনের কাছে। বন্ধু দিবস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আবেগঘন হয়ে পড়েছিলেন, “ছোটবেলা থেকে যেহেতু দেশে বড় হয়েছি, সেহেতু দেশের বন্ধুদের সাথে কাটানো সময়গুলো সত্যিই চির রঙিন। তবু, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কখনো কখনো মোবাইল স্ক্রিনই বন্ধুত্ব রক্ষার একমাত্র মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। কোভিড পূর্ববর্তী দিবসে আমি দেশে ছিলাম। খুব সম্ভবত সেদিন আমার লন্ডনে ফেরত আসার তারিখ ছিল। তারা আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে তার ফাঁকে এমন কিছু উপহার রেখেছিল, যা ভেবে আজও কান্না-হাসি খেলা করে।”
প্রবাসজীবন এবং ‘নিউ নরমাল’সময়ে বন্ধু দিবস পালনের আয়োজন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “দেশের বন্ধুদের খুব বেশি মিস করছি। তবে, এখানেও এমন কিছু বন্ধু পেয়েছি, যারা সত্যিই খুব কাছের। গত তিন বছর ধরে বাঙালি মেয়েদের সবচেয়ে পছন্দের খাবার চটপটি, ফুচকা থেকে আমি দূরে ছিলাম। এখানকার বন্ধুরা, আজ সেটি এনে দিলে আমি প্রচণ্ড আনন্দ বোধ করি। আমার মনে হয়, বন্ধু দিবসের আগাম সেরা উপহার বোধ হয় এটি। আর ‘নিউ নরমাল’বলতে, এখানে সব খুলে দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই চলতে পারছি আমরা। এবার বন্ধু দিবসে সিনেমা দেখার পাশাপাশি দূরে কোথাও ঘুরতে যাবার পরিকল্পনা আছে।”
বন্ধু দিবসের পরিকল্পনা ও বিশেষ স্মৃতি জানতে চাইলে, সিলেটের সংস্কৃতিকর্মী সুস্মিতা অর্পা বলেছিলেন, “বড় হবার মারপ্যাঁচে আগেকার সে বন্ধুসভা আর জমে ওঠে না। স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত একসাথে থাকা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রিয় বন্ধুগুলোর পথ বদলে যায়। দেখা তো হয়। কথাও হয়। কিন্তু, পাশাপাশি বসে দীর্ঘ আলাপ সে তো বরাবরই স্বর্গীয়।”
কোভিড পূর্ববর্তী সময়ে বন্ধু দিবসের কোনো বিশেষ স্মৃতি প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছিলেন, “আমরা পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম। সারাদিন অনেক খাওয়াদাওয়া, অনেক উন্মাদনা। এবার বড়জোর একটা ভিডিও কল, আর অনলাইনে খাবার অর্ডার দেয়া ছাড়া আর কিছু করার হয়তো থাকবে না।”
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জনাব হোসেন (ছদ্মনাম) বন্ধু দিবসের কথা শুনে রীতিমতো হাসিমিশ্রিত কণ্ঠে বলে ওঠেন, “বন্ধু তো রোজই লাগে। দিবস টিবস আবার কী! তবে হ্যাঁ, আমার মনে পড়ে, একবার আমরা বিশেষ একটা কাজে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। সেখানে হঠাৎ চোখে পড়ে, কিছু স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়ে সাগরের কাছে একটি কেক নিয়ে উল্লাস করছে। কাছে যেতেই দেখি, কেকে লেখা ‘হ্যাপি ফ্রেন্ডশিপ ডে’।
পরে আমার কিছু বন্ধুদের নিয়ে বাচ্চাদের সাথে আমরাও পালন করি দিনটি। এরপর তো প্রায় আটত্রিশ বছর কেটে গেছে। আমরা রোজই আড্ডা দিই। আমার পাশের ফ্ল্যাটেই কিছু বন্ধু থাকে। একসাথে এখনো চা খাই, গান গাই। আর আপনি যেহেতু মনে করিয়ে দিলেন, সেহেতু ওই বাচ্চাদের স্মৃতিচারণ করতে অন্তত এবার দিবসটি পালন করব।”
সব ঘর ঘুরে এসে, বন্ধুদের নিয়ে নিজেও ভাবা হলো। মনে হলো, হারিয়ে যাওয়ার তুমুল দাবি নিয়েই কেউ কেউ বন্ধু হতে আসে। সংখ্যায় কমে যেতে যেতে শেষমেশ কিছু বাকি থাকে, ওই অবশিষ্ট অংশটুকুই যেন আমার বন্ধু। সে যা-ই হোক, হৃদয়ের আনাচে-কানাচে বন্ধুদের চলাফেরা বাড়ুক, বন্ধুত্বের বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের হৃদয়ের উত্তাপে জ্বর আসুক, বাড়ুক। আগামী বছরের বন্ধু দিবসে যেন ঘরে বন্দী থেকে নয়, খোলা মাঠে-ব্যস্ত হাটে বন্ধুর হাতে হাত রেখে করোনামুক্ত জগতে উদযাপন করতে পারি, এই কামনা রইল।
সঞ্জয় দত্ত বর্তমানে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।