Loading...

ফোমো বা বাদ পড়ে যাবার ভয় কীভাবে কাটাই

| Updated: May 15, 2021 20:32:26


Courtesy: Freepik Courtesy: Freepik

সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা শিখরে পৌঁছার পর আমাদের সামাজিক জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগে সামনাসামনি দেখা না হলে যে খবর জানতে পারতাম না, এখন তা শোবার ঘরে দিনভর শুয়ে থেকেও পেয়ে যাই। বন্ধুমহল বা পরিচিতবৃত্তের কে কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কোন রেস্তোরাঁয় দল বেঁধে খেতে গেছে কিংবা কার সাথে কার কেমন বনিবনা- এর সবকিছুই যেন নিউজফিড স্ক্রলিং আমাদের মস্তিষ্কে কিছুক্ষণ পর পর হালনাগাদ করে দেয়। আমাদের মনও বোঝাই হতে থাকে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বহু তথ্যে। আর সেসব তথ্য আমাদের মনে জানা-অজানায় সৃষ্টি করে এক অদ্ভুত ভয়। তার নাম ‘বাদ পড়ে যাবার ভয়’। চলতি জামানার এই ক্রমবর্ধিষ্ণু সামাজিক উদ্বেগকে শহুরে অভিধানে একটা ছান্দসিক নামও দেয়া হয়েছে; ফোমো (FOMO)। ইংরেজিতে এর পূর্ণরূপ ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’।

হয়তো আপনি আজ সারাদিন বলার মতো তেমন কিছুই করেননি, শুয়েবসে কাটিয়ে দিয়েছেন। এতে এমনিতেই নিজের মাঝে অপরাধবোধে ভুগছেন। ভাবলেন, একটু ঘুরে আসি নিউজফিডে, দেখে আসি কে কী করছে। এখানেই লেগে গেল বাগড়া। বন্ধুবান্ধবের এত এত নতুন অর্জন বা কাজকর্ম দেখে একটু আগের অপরাধবোধের খুদে বীজটা এখন চারাগাছে রূপ নিয়েছে। যাকে অতিরিক্ত চিন্তার মাধ্যমে আপনিই পেলেপুষে বৃক্ষে রূপান্তরিত করছেন, প্রতিদিন, একটু একটু করে।

অথবা, আপনার কয়েকজন বন্ধু হয়তো আপনাকে ছাড়াই আড্ডা দিয়েছে, হাসিখুশি ছবি পোস্ট করেছে নিজেদের টাইমলাইনে। কমেন্টের ছড়াছড়িতে সে আড্ডার মজার বিভিন্ন বিষয় উঠে আসছে। আপনাকে হয়তো ডাকা হয়েছিল, কিন্তু আপনি নিজেই যাননি। হতে পারে, এই সময়টাতে আপনি নিজেই কোনো মজার কাজ করছিলেন। তারপরও কিন্তু এই বাদ পড়ে যাবার ভয় আপনার পিছু ছাড়বে না। চেনা লোকেদের মাঝে নিজেকে মনে হবে এলিয়েন প্রজাতির কেউ। এই ভীতি কিংবা বিচ্ছিন্নতাবোধ একটা শৃঙ্খলের মতো আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে, আপনি হয়তো আন্দাজও করতে পারছেন না। মানসিক স্বাস্থ্যে কিন্তু তার ভালো প্রভাবই পড়ছে। যখন কোথাও ভালো কিছু ঘটছে, এবং আপনি সেখানে উপস্থিত নেই, ফোমো’র শেকড়টা মূলত সেখানেই গাড়া।

সাইকোলজি টুডে’র একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কার্লেটন এবং ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু গবেষকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, দিনের শেষে কিংবা সপ্তাহের শেষে পরীক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে ফোমো’র প্রবণতা বেশি পরিলক্ষিত হয় এবং নিয়মিত ফোমো’র শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক চাপ, ক্লান্তি, নিদ্রাজনিত সমস্যা ইত্যাদি দেখা যায়।

সাধারণত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ ভীতি বেশি জেঁকে বসে। এর কারণ হিসেবে তারুণ্যের প্রতি সবার অবিরত প্রত্যাশা তো আছেই। তরুণরা উপভোগ করবে, বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপ নেবে এবং অর্জনের তালিকায় একে একে যোগ করবে প্রশংসনীয় কাজ; প্রত্যাশার তালিকাটা একেবারে ছোট নয়। নিজেদের তারুণ্যের এই সর্বোচ্চ উপযোগ ঘটানোর প্রবণতা থেকেও একসময় জন্ম নিতে পারে ফোমো।

ফোমো’র জন্ম দেয় ব্যক্তির মধ্যে বাস করা মুহূর্মুহূ দ্বিধাও। সেক্ষেত্রে বিকল্পগুলোকে যাচাই-বাছাই করে এর ভালো-মন্দ সবদিক বিবেচনা করে জানতে হবে, কোনটিকে এ মুহূর্তে বেশি প্রাধান্য দেয়া দরকার। প্রাধান্য নির্ধারণের পর আসে এ বিষয়ে ‘করণীয়’ নির্বাচনের পালা।

এ অদ্ভুত ভীতি থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়টাও কিন্তু এর গ্যাঁড়াকলে পড়ার মতোই সোজা, যদি তা ঠিকঠাক মেনে চলা যায়। প্রথমেই নিজের বাদ পড়ে যাবার ভয়গুলোর একটা ছোট্ট তালিকা করে ফেলা যাক, পাশে রাখা হোক দুটো ঘর; লাভ আর ক্ষতির। যখন আপনি কোথাও বাদ পড়ে যাচ্ছেন বলে মনে মনে দুঃখ হচ্ছে, সেই ঘটনাটি তালিকায় যোগ করে নিন। প্রথমেই ভয়ের হাজিরা দিন। লিখে ফেলুন, কী হারালেন, সে ঘটনার সাথে যুক্ত না থাকতে পেরে। তারপর আসা যাক লাভের জায়গায়। এতে লিখুন, সেখানে না গিয়ে বা সে কাজটি না করে এর বিকল্প হিসেবে আপনি মজাদার বা দরকারি কিছু করেছেন কি না এবং করে থাকলে সেটি কী। এ কাজটি করার পর হারানোর বিষয়টি আর আগের মতো দুঃখজনক লাগবে না আশা করি।

লাভের খাতা ভারি করার জন্য আরেকটি কাজও করা যেতে পারে। যখন কিছু থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছেন বা যাবেন বলে মন কেমন করে তখন তার বিপরীতে নিজেকে উপহার দিন ভালো কিছু সময়। আর এভাবেই ধীরে ধীরে যখন লাভের খাতায় যুক্ত হবে একের পর এক প্রাপ্তি, ভয়কে জয় করা খুব কঠিন হবে না।

তবে তথ্য-প্রযুক্তির তুঙ্গে থাকা এ সময়ে শুধু কি উপরে আলোচিত বিষয়েই সীমাবদ্ধ আছে মানুষের বাদ পড়ে যাবার ভয়?

ফোমো’র অন্য এক দিক তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাবীন বিভ বলেন, “এখন কোনো ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব আলোচনা হলে কিন্তু সেটা নিয়ে না জানলে মনে হয়, সবার চেয়ে পিছিয়ে আছি। সবার সব জানতেই হবে এমন নয়। কিন্তু যেহেতু জানার সুযোগ আছে, বাকিরা জানছে, সেসব নিয়ে চিন্তা করছে, কথা বলছে তাই কোনো কারণে কিছু এড়িয়ে গেলে নিজের ওপর বিরক্ত লাগে।”

অর্থাৎ, তথ্যের অবাধ প্রবাহ জন্ম দিয়েছে ফোমো’র এক নতুন প্রকরণের। ‘জানার কোনো শেষ নাই’- সেকথা আমরা যতই জানি না কেন, অন্যে যা জানছে, তাতে নিজেদের এখতিয়ার না থাকলে নিজেকে বোকা মনে হওয়াটা এ যুগে অস্বাভাবিক নয় একদম। কেননা, জ্ঞান জাহিরের বিশাল প্ল্যাটফর্ম এখন আমাদের মুঠোফোনের মধ্যেই। সেক্ষেত্রে আমাদের নিজেদেরকে প্রয়োজনীয় সব তথ্যের সাথে হালনাগাদ রাখার সাথে সাথে খানিক প্রশ্রয় দিতে হবে নিরীহ অজ্ঞতাকেও। আগ্রহ, প্রয়োজনীয়তা, প্রাসঙ্গিকতা- এসব নিয়ামকের উপর ভিত্তি করে জানার গণ্ডি বিস্তৃত হোক। আর এর পরও কিছু যদি না জানা হয়, তবে পরে তা জেনে নেবার সুযোগ তো থাকছেই। তাই জ্ঞান সংক্রান্ত ফোমো’কেও এবারে বলা যাক, “বিদায়”।

এ লেখার ইতি টানা যায় সাম্প্রতিক বেশ জনপ্রিয় একটি বলিউডি সিনেমা ‘ইয়ে জাওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র এক প্রধান চরিত্র নয়না’র সংলাপ দিয়ে। সে যা বলেছিল, তার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, “যতই চেষ্টা করো, জীবনে কিছু না কিছু তো হারাবেই। তাই আপাতত যেখানে আছি, সেখানেই ভালো থাকি না কেন!” নয়না’র সাথে সুর মিলিয়ে তাই বলা যায়, অনেক অনেক বিকল্পে ভরা এই জীবনে সবকিছু দুটো হাতের মুঠোয় ঠাঁই হবে না, বরং একসাথে সব বেঁধে ফেলতে গেলে শিথিল হয়ে যাবে দৃপ্ত হাত নিজেই। তাই আটোসাঁটো না হয়ে মুক্তভাবেই শ্বাস নিক জীবনের সব তৃপ্তি।

অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন।ই-মেইল[email protected]

 

 

Share if you like

Filter By Topic