Loading...

ফিলিস্তিনীদের নিরন্তর হেঁটে চলা

| Updated: May 16, 2021 13:16:06


ফিলিস্তিনী লেখক রাজা শেহাদেহ তাঁর বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন ফিলিস্তিনী লেখক রাজা শেহাদেহ তাঁর বই থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন

ফিলিস্তিনীরা হাঁটছে। সাত দশকের বেশি সময় পেরিয়ে তাদের হাঁটা শেষ হয়নি। আজ থেকে ৭৩ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে তাদের এই নিরন্তর  হাঁটা শুরু হয়। প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিনের মাটিতে একাধারে কূটচাল, সন্ত্রাস ও জবরদখল খাটিয়ে ইহুদিদের কথিত ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ ফিরে পাওয়ার নামে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্র ঘোষিত হয় এই মাটিতে। সঙ্গে সঙ্গে নেমে আসে সেখানকার অধিবাসীদের ওপর চরম বিপর্যয় যা ‘আল-নাকবা’ হিসেবে পরিচিত (১৫ মে নাকবা দিবস)। সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনীদের নিজভূমি থেকে বিতাড়িত ও রাষ্ট্রহীন হওয়ার বিপর্যয় থেকে তাদের এই হাঁটা শুরু।

ফিলিস্তিনী আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী রাজা শেহাদেহ তাঁর ‘প্যালেস্টিনিয়ান ওয়াকস’ বইতে যেন এই নিরন্তর হাঁটার প্রতীকি ছবি এঁকেছেন এক অদ্ভূত ব্যাঞ্জনায়। ’৭০-য়ের দশকে দখলকৃত ফিলিস্তিনের বিভিন্ন পাহাড় ও উপত্যকায় দিনের পর দিন তিনি হেঁটে বেড়াতেন। অনুভব করতেন নিজের দেশ-মাটির অনন্য বৈশিষ্ট্য- হাজার বছরের যে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয়নি। পশ্চিমতীরের রামাল্লায় বেড়ে ওঠা শেহাদেহ পর্যবেক্ষণ করতেন ফিলিস্তিনের উচ্চভূমির একদিকের ঢালে সমুদ্র আর আরেকদিকের ঢালে মরুভূমিকে। এই হেঁটে বেড়ানোর শুরুর দিকটায় তিনি জানতেন না যে কালক্রমে ফিলিস্তিনের এই মনোরম ও বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট বিকৃত, বিনষ্ট ও অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকবে তাঁর চোখের সামনেই। তিনি ও তাঁর মতো লাখ লাখ ফিলিস্তিনী অসহায়ের মতো শুধু দেখবেন, কিছু করতে পারবেন না। এই বিকৃতি-বিনাশ ঘটেছে তাদের হাত দিয়ে যারা দাবি করে যে এই ভূমি তাদের নিজেদের প্রাচীন ভূমি, তাদের আদিপুরুষদের বাসস্থল, তাদের জন্য ঈশ্বরের মনোনীত ভূমি।

শেহাদেহর মতে, ফিলিস্তিনের জন্য সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো এই ভূমি ঘিরে পশ্চিমা দুনিয়ার ঐতিহাসিক ও বাইবেলভিত্তিক কল্পনাচিত্র। এই কল্পচিত্রই তাদেরকে প্ররোচিত করেছে এখানে ইহুদিদের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের- স্থানীয় অধিবাসী ও আদিবাসীদের তাড়িয়ে দিয়ে, তাদের জমি-জমা, বাগান-পানি, ঘর-বাড়ি দখল করে এবং তাদেরকে কার্যত খাঁচায় বন্দি করে।

বইতে শেহাদেহ তাঁর সাতটি হাঁটার কাহিনী তুলে ধরেছেন- ১৯৭৮ সালে যার শুরু ও ২০০৭ সালে যার শেষ। আইনজীবী হিসেবে ফিলিস্তিনীদের ভূমি গ্রাস করার ইসরায়েলী নীতি ও বিধি-বিধানের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তিনি আবিস্কার করেছেন কতোটা কৌশলী ও নিষ্ঠুরভাবে মাটি-পানির দখল নিয়েছে ইসরায়েল। পাহাড় কেটে, জঙ্গল সাফ করে ও পানির প্রাকৃতিক প্রবাহ ঘুরিয়ে ইহুদি বসতি তৈরি করা হয়েছে, জলপাই বাগান ধ্বংস করে গাড়ি চলাচলের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া টেনে বিছিন্ন ও কোণঠাসা করে দেওয়া হয়েছে ফিলিস্তিনীদের। পূর্ব ইউরোপ থেকে আগত এই ইহুদিরা সেখানে এই বিশ্বাসে বসবাস করে চলেছে যে এখানেই তাদের পূর্ব পুরুষদের আবাস ছিল যদিও তারা কখনোই বলতে বা জানাতে পারেনি যে তাদের কোন পূর্বসূরি এখানে কবে ও কিভাবে বসবাস করেছিল। যেমন ওয়াদি দালবের উপত্যকায় হাঁটতে এসে বন্দুকধারী এক তরুণ ইহুদির মুখোমুখি হন শেহাদেহ। তাঁদের  কথোপকথনের একটি অংশ ছিল এরকম:

[ইহুদি তরুণ:] “তোমরা কোনো জাতি নও তোমাদের কখনোই কোনো নিজস্ব সরকার ছিল না, নেই

[শেহাদেহ:] “তুমি কী তাহলে গোল্ডা মেয়ারার সেই বিখ্যাত উক্তিই মনে করাচ্ছ  যে আমাদের মানে ফিলিস্তিনীদের কখনোই কোনো অস্তিত্ব ছিল না নেই?”

না,আমি তা বলিনি আমি জানি যে তোমাদের অস্তিত্ব আছেআমি তোমাকে আমার সামনেই দেখতে পাচ্ছি আর তুমি ইসরায়েলী নও  নিশ্চয়ই তুমি আছো, তোমাদের অস্তিত্ব আছে কিন্তু এই ইসরায়েলের ভূমিতে তোমাদের কখনোই জাতিগতভাবে উপস্থিতি ছিল না

তোমাদের ছিল?”

হ্যাঁ এখানেই ছিল আমাদের জুদিয়া রাজ্য

সেটাতো আজ থেকে তিন হাজার বছরের বেশি সময় আগে

তাতে কী?”

জেরুজালেম হেবরনে গুটি কয়েক ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ ছাড়া সেই সময় থেকে এই পশ্চিম তীরে ইহুদিরা কখনোই বাস করেনি এই ভূমিতে সবসময় আরবদের আধিক্য ছিল তোমার চোখে এটা ধরা পড়েনি

ইহুদিদের তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে তিন হাজার বছর লেগেছে এটাই একমাত্র দেশ যা আমরা পেয়েছি আর তুমি চাও আমরা এটা ছেড়ে দেই?”

তোমরা পুরো দেশটা শুধু তোমাদের জন্য চাও, অন্য কাউকে এতটুকু ভাগ দিতে চাও না এটা কী বৈষম্য নয়?”

কিসের বৈষম্য? আমরা যা করছি তাতে ভুল কোথায়?” [পৃ-১৯৯-২০০]

পাহাড়-উপত্যকা-জঙ্গল-ঝর্ণাধারার মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শেহাদেহ আমাদেরকে নিয়ে যান প্রকৃতির নির্মলতা-রুক্ষতার সঙ্গে মানুষের অসহায়ত্ব ও নির্মমতার বিভিন্ন ঘটনার কাছে। ফিলিস্তিনী আরবরা যে ঝর্ণা থেকে বালতি ভর্তি করে পানি নেয়, সেই ঝর্ণাধারা আটকে দিয়ে কৃত্রিম জলাধার তৈরি ও তা থেকে নল দিয়ে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে ইহুদি বসতিগুলোয়। আর আশেপাশের গ্রামগুলোর ফিলিস্তিনীদের বাধ্য করা হয়েছে  চড়াদামে সেই পানি কিনতে, তাও সীমিত পরিমাণে।

শেহাদেহ হেঁটেছেন রামাল্লা থেকে হাররশায় পাহাড়ের ওপর দিয়ে, জেরুজালেমের বনজ এলাকায়, জর্দান সীমান্ত ঘেষা মৃত সাগরের পাশে কিংবা জেরিকোর সবুজ উপত্যকায়। এই হাঁটার বর্ণনা কখনো প্রাণবন্ত, কখনো করুণ, কখনো হৃদয়গ্রাহী, কখনো বেদনাবিধূর। তাঁর লেখনী ফিলিস্তিন ট্র্র্যাজেডির একটি প্রামাণ্য দলিল হয়ে থাকবে।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic