সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিমিত খাবার খেতে হবে- একথা আমরা প্রায় শুনে থাকি। কিন্তু পরিমিত খাবার বলতে কী বোঝায়, এর অর্থ অনেকের জানা নেই। সত্যিকার অর্থেই পরিমিত খাবারের কোনো ধ্রুব সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। কারণ, পরিমিত খাবার সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্যক্তির উপর। প্রত্যেক ব্যক্তির উচ্চতা, ওজন ও খাবার আত্তীকরণ শক্তি সমান না। আবার বয়স ও লিঙ্গভেদেও শারীরিক পার্থক্য লক্ষ করা যায়। তাই, পরিমিত খাবার কী এবং কেমন হবে, ব্যক্তিভেদে তা ভিন্ন হতে দেখা যায়।
তবে কোন কোন উপায়ে পরিমিত খাবার গ্রহণ করা যায় এবং করলে এর উপকারিতা কী, এ বিষয়টি নির্দিষ্ট। আজকের লেখায় আলাপ হবে এই দু'টো প্রশ্নকে কেন্দ্র করেই।
যেভাবে শুরু করা যায়
ক্যালোরির ঠিকঠাক হিসেব রেখে খাওয়াদাওয়া করা একটু কষ্টকর। তাছাড়া এতে অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। বিশেষ করে আপনি যদি গতানুগতিকভাবে ভাত-মাছ খেয়ে অভ্যস্ত হন, তাহলে এটি প্রায় অসম্ভব। তাই ক্যালোরি হিসেবের ঝামেলা এড়িয়ে, খুব সহজেই নিম্নলিখিত উপায়ে পরিমিত খাবার গ্রহণ করা সম্ভব।
১. চলমান খাবারের তালিকা তৈরি করা:
প্রথমে, আপনি বিগত তিনমাস ধরে যা খেয়ে আসছিলেন তার একটি তালিকা তৈরি করুন। তালিকাতে কোন কোন সময় কী ধরনের খাবার গ্রহণ করতেন; অর্থাৎ, আমিষ, শর্করা এবং চর্বি ইত্যাদির একটি তালিকা তৈরি করুন। তালিকাটি তৈরি হয়ে গেলে আপনি বুঝতে পারবেন, আপনার গ্রহণকৃত খাদ্যের নমুনা ও পরিমাণ।
অতঃপর যে ধরনের খাবারের পরিমাণ বেশি ছিল, তার উপর নজর দিন এবং এর পরিমাণ একটু কমিয়ে নিন। আর যে ধরনের খাবার কম পরিমাণে গ্রহণ করে আসছিলেন, তার পরিমাণ বাড়িয়ে নিন। এভাবে আপনার খাবারের মাঝে একটি ভারসাম্য তৈরি হবে। ফলে, পরবর্তী ধাপ গুলো অনুসরণ করতে সহজ হবে।
২. খাবারের সুষম বণ্টন:
তালিকা সম্পূর্ণ হবার পর খাবারের সুষম বণ্টন করা প্রয়োজন। এর জন্য দিনের ২৪ ঘণ্টাকে খাবারের ধরনের ভিত্তিতে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নেয়া যেতে পারে। প্রধানত, আমরা দিনে যথাক্রমে সকাল, দুপুর ও রাত মিলে তিন বেলা খাবার গ্রহণ করে থাকি। সন্ধ্যাবেলায় থাকে হালকা নাস্তার ব্যবস্থা। অনেকেই সকালে শর্করা হিসেবে রুটি গ্রহণ করে আবার দুপুর ও রাতেও শর্করা হিসেবে ভাতের উপস্থিতি থাকে। এতে করে একই ধরনের খাবারের আধিক্য দেখা যায়।
তাই দিনে তিন/চার বেলা খাবার গ্রহণ না করে এটিকে আরো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন: সকাল, দুপুরের খাবারের দুই-তিন ঘণ্টা আগে, দুপুর ও সন্ধ্যার মধ্যবর্তী সময়, সন্ধ্যায় এবং রাতে। এভাবে একাধিকবার অল্প পরিমাণ করে আহারের মাধ্যমে পরিমিত খাদ্য নিশ্চিত করা যেতে পারে।
৩. খাবার চয়ন:
খাবারের সুষম বণ্টন নিশ্চিত হলে আপনি খাদ্য চয়নের কাজটি শুরু করবেন। অর্থাৎ, দিনে যতগুলো সময়ে আহার ভাগ করেছেন, তখন আপনি কী কী খাবার খাবেন, তা নির্দিষ্ট করবেন।
যেমন: সকালে খেতে পারেন টোস্ট আর ডিম, দুপুরের আগে ফল খাওয়া যায়। দুপুরে অল্প ভাতের সাথে পরিমাণমতো সবজি। সন্ধ্যা বা সন্ধ্যার আগে বাদাম খাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া বেশি বেশি সালাদ, শসা ও বিভিন্ন মৌসুমী ফল খাবেন। রাতে দেরি করে খাবার খাওয়া যাবে না। রাতের খাবারে ভাতের পরিবর্তে একটি রুটি এবং অল্প তেলে তৈরী সবজি বা মাছ-মাংস খাওয়া যেতে পারে। মাঝরাতে আবার ক্ষুধা লাগলে গ্রিন টি’র সাথে একমুঠ পরিমাণ বাদাম এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
তেল জাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে, একেবারেই সম্ভব না হলে অল্প তেলের খাবার খেতে পারেন। সয়াবিনের পরিবর্তে সরিষা ভালো, তবে সব থেকে উত্তম অলিভ অয়েল, বিশেষত এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল।
৪. ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ:
অনিয়মতান্ত্রিক খাবারের চক্রটি পরিবর্তন করার ফলে দিনের বিভিন্ন সময় ক্ষুধা লাগতে পারে। বিশেষ করে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বা কোথাও বেড়াতে গেলে মুখোরোচক খাবার দেখে খেতে ইচ্ছে করতে পারে। তখন ধৈর্যধারণ করতে হবে। খেতে ইচ্ছা করলে ফল বা বাদাম এবং প্রচুর পরিমাণ পানি দ্বারা ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে। তেল বা চর্বি জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া যাবে না।
৫. নিয়মিত রুটিন অনুসরণ:
সর্বশেষ যে কাজটি করতে হবে, তা হলো তৈরি করা নিয়মটি যথাযথভাবে পালন করতে হবে। অভ্যাস ত্যাগ করা যায় না, তবে পূর্ববর্তী অভ্যাস নতুন অভ্যাস দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যায়। পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে হলে আমাদের এই নীতি অনুসরণ করতে হবে।
তাই পরিমিত খাবারের নিয়মাবলী তৈরির পর, কঠোরভাবে অন্তত বারো সপ্তাহ তা পালন করতে হবে। টানা একমাস একটি নির্দিষ্ট রুটিন অনুসরণ করলে সেটি অভ্যাসে পরিণত হওয়া শুরু হয়। তাই প্রথম কয়েকদিন ক্ষুধা লাগলেও, পরিমিত খাবারের নতুন রুটিন, প্রতিদিন অনুসরণ করার ফলে এটিই নতুন অভ্যাসে পরিণত হবে। তারপর এটি চলমান রাখতে কোনো সমস্যা হবে না।
পরিমিত আহারের প্রয়োজনীয়তা
পরিমিত আহারের ফলে আপনার দেহে কোনো বিশেষ উপাদানের আধিক্য সৃষ্টি হবে না। কেননা, পরিপাক খাবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তেল-চর্বি বা মাংস জাতীয় খাবার পরিপাক হতে অনেক সময় নেয়। ফল ও সবজি তুলনামূলক খুব সহজে পরিপাক হয়ে যায়। তাই পরিপাক ক্রিয়া স্বাভাবিক রাখার জন্যেও পরিমিত খাবারের প্রয়োজন।
পরিমিত খাবার দেহের বিভিন্ন উপকারে আসে। দেহ রোগমুক্ত থাকে, অতিরিক্ত ওজনের হ্রাস ঘটে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, ত্বক সতেজ থাকে এবং সর্বোপরি খাদ্যের বিভিন্ন উপাদানের সমবণ্টনের ফলে দেহে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
উন্নত জীবনযাপনের অন্যতম একটি শর্ত হলো, মানুষের সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া। আর এর জন্য পরিবেশের পাশাপাশি খাবারের দিকেও আমাদের নজর দিতে হবে। অতিরিক্ত আহারের ফলে সাময়িক তুষ্টি অর্জন হতে পারে, কিন্তু বৃহৎ পরিসরে ক্ষতির পরিমাণই বরং বেশি। যারা কীভাবে শুরু করবেন বা কীভাবে রুটিন করলে সুবিধা হয়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, তারা এই লেখায় বর্ণিত পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করতে পারেন।
মোঃ ইমরান খান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।