দক্ষিণ সুদানের অর্থনীতির অনেকটাই নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর। ২০১৩ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার মাত্র দুবছর পরে দেশটির মোট দেশীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯.৩ শতাংশ। কিন্তু ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতি ২১.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়। দাতারা এর কারণ হিসেবে তেলের মূল্য পতন, সশস্ত্র সংঘাত এবং অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেন। এরপরও দেশটির অর্থনীতি ২০১৯ সালে একদফা ০.৯ শতাংশ বেড়ে তারপরই গত বছর আবার ৬.৬ শতাংশ সংকুচিত হয়।
দক্ষিণ সুদানের তেলক্ষেত্রগুলো ২০১১ সালে সাড়ে তিন লাখ ব্যারেল তেল উত্তোলন করেছে। চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের মাধ্যমে তেল খাতে শীর্ষ বিনিয়োগকারী ছিল বেইজিং। তেলখাত থেকে প্রাপ্ত রাজস্বকে টেকসই প্রবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ করার সত্যিকার কোনো পরিকাঠামো নবজাত দেশটির ছিল না। অথচ, আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক, দক্ষিণ সুদানের ৭০ শতাংশ জিডিপি এবং রাষ্ট্রীয় রাজস্বের ৯০ শতাংশের জন্যেই নির্ভর করতে হয়েছে জ্বালানি তেলের ওপর।
জুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর জন অ্যাকি বলেন, সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট (এসপিএলএম) সরকার চালানোর উপযোগী করে নিজ লোকদের গড়ে তোলেনি। তিনি আরো বলেন, “যখন সুদানের অংশ হিসেবে ছিলাম, দক্ষিণ সুদানবাসীদের হাতে কোনো ক্ষমতা ছিল না এবং সরকার পরিচালনার কাজে অনভিজ্ঞ ছিলাম। কাজেই আমাদের শিখতে হয়েছে। এখন আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক কিন্তু সে দেশ চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। ফলে কাজ করে, ভুল করে আমাদের শিখতে হচ্ছে। এভাবে ঠেকে শিখতে গেলে দীর্ঘ সময় লাগে।”
গত এক দশকে দক্ষিণ সুদানের দৈনিক জ্বালানি তেল উত্তোলনের হার কমে দেড় লাখ ব্যারেলে এসে ঠেকেছে। স্থলবেষ্টিত দেশটির অপরিশোধিত তেল রফতানির কোনো অবকাঠামো নেই এবং জাহাজযোগে এ তেল রপ্তানির জন্য সুদানকে পারিশ্রমিক দিতে হয়।
মানবিক ত্রাণের ওপর নির্ভরতা কমাতে দক্ষিণ সুদানের উন্নয়ন প্রকল্পে ৩২ কোটি ডলার বিনিয়োগ করবে বিশ্বব্যাংক। এদিকে তেলমন্ত্রী পাউট কাং চোল দেশটির তেল খাতে ৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। কে এ বিনিয়োগ করবে সে কথা উল্লেখ না করে তিনি বলেন, “এই বিনিয়োগ দেশকে ভিন্ন একটি পর্যায়ে নিয়ে যাবে…সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত হবে এবং দক্ষিণ সুদানবাসীরা এ জন্য গর্ব বোধ করবেন।”
দক্ষিণ সুদানের কৃষির ক্ষতি করছে বন্যা ও পঙ্গপাল। দেশটির জেডিপির ১৫ শতাংশের যোগান আসে এ খাত থেকে। আর কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ। মুদ্রার অবমূল্যায়নের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল(আইএমএফ) বলেছে, দক্ষিণ সুদানে চলতি বছর মূল্যস্ফীতির হার ৪০ শতাংশে যেয়ে দাঁড়াবে। গত বছর এ হার ৬৬.১ শতাংশ ছুঁয়েছিল। দক্ষিণ সুদানে কর্মরত বিদেশি ব্যাংকের এক কর্তা বলেন, “দেশটিতে রাজনৈতিক সমস্যা আছে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাতে অর্থনৈতিক তৎপরতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, “রাজস্ব খাত থেকে যে অর্থ তারা পাচ্ছে তার সবই ব্যয় করছে যুদ্ধ।”
রাজনীতিবিদ, বিশ্লেষক এবং কূটনীতিবিদরা সবাই একমত যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ার দিক ঝুঁকতে হবে এবং জরুরিভিত্তিতে যুদ্ধ থেকে সরে আসতে হবে। কিন্তু দেশটিতে বিরাজমান রাজনৈতিক অভিলাষের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সম্পদের বিতরণ এবং এক জাতিগত জনগোষ্ঠীর ওপর আরেক জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা নিয়ে দেশটিতে হাঙ্গামা-হুজ্জত এবং সহিংসতা ঘটছে। এই দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন আজো ঘটেনি। এদিকে সরকারি কর্তাদের হিসাবে বলা হয়েছে, দক্ষিণ সুদানের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।
দক্ষিণ সুদানের সেন্ট্রাল ইকুএটোরিয়ার ইয়ে অঞ্চলের কমিশনার অ্যাগ্রি সাইরাস কানিইয়াকাওয়া বলেন, “ক্ষুধা এবং দারিদ্র সংঘাতকে বাড়িয়ে দেয়। সংঘাতের পেছনের কারণই হলো এটি। এখন যদি আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি, ঘরের বহু মানুষই উৎপাদনের কাজে লাগবে।” ১৯৯০’এর দশকে দেশটির প্রেসিডেন্ট সালভা কিরের সঙ্গে একযোগে লড়াই করেছেন তিনি। তিনি আরো বলেন, “বন্দুকের জোরে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই।”
জুবাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং এসপিএলএম/এর সাবেক যোদ্ধা আব্রাহাম কাউল নেউন বলেন, “স্বাধীনতার আগে আমাদের একটা মাত্র পরিচয় ছিল, আমরা সবাই ছিলাম দক্ষিণ সুদানবাসী। দক্ষিণ সুদানের মানুষ স্বাধীনতা পেলো, কিন্তু আমরা একটি মাত্র শত্রুকেই চিনতাম। সেই একটি মাত্র শত্রু না থাকায় সেখানে এক বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি হলো।”
২০১১ সালে স্বাধীনতা প্রশ্নে সুদানে যখন গণভোট হয় তখন কেউ নিজদেরকে (দক্ষিণ সুদানের বৃহত্তর জাতিগত গোষ্ঠী) নুয়েরের বা (অন্যতম জনবহুল জাতিগত গোষ্ঠী) দিনকার সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয়নি। এ ছাড়া তখন জাতিগত ভাবধারা পুষ্ট চেতনাও দক্ষিণ সুদানবাসীদের মধ্যে ছিল না। দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পর দেশটির মানুষের চেতনা পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরতে যেয়ে তিনি বলেন, “স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের সামনে এলো একটা কেক এবং কেউ কেউ বলতে শুরু করল, তারা একাই এ কেকটি খাবে। এতে অন্য আরেক দল বলতে শুরু করল, ‘যদি তোমরা একাই সব কেক খেতে চাও তবে আমরা যুদ্ধে নামবো’।”
থিংক ট্যাংক ক্রাইসিস গ্রুপের সুদান বিশেষজ্ঞ অ্যালান বোসওয়েল দক্ষিণ সুদানের মানুষদের মধ্যে বিরাজমান মনোভাব নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “শুধু বিজয়ীই সব কিছুর অধিকারী হবে এ মনোভাবের পরিবর্তন না ঘটলে দেশটির ৬০ জাতিগত গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগ-বাটোয়ারা করার মনোভাবের উন্মেষ না ঘটলে বিরাজমান সংঘাত অন্তহীন ভাবেই চলতে থাকবে।” মনোভাবের আশু পরিবর্তন ঘটবে বলেও মনে করেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং এসপিএলএম/এর সাবেক যোদ্ধা আব্রাহাম কাউল নেউন। তিনি বলেন, “কির যখন ক্ষমতায় (তাঁর প্রতিপক্ষ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট) রিয়েক মাচার মোটেও খুশি হন না। অন্যদিকে মাচার কখনো ক্ষমতায় আসুক তা মেনে নেবে না কির। উভয়ের জন্যেই এগিয়ে যাওয়া সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
নেউন আশঙ্কা করেছেন ২০২৩ সালে দেশটিতে যে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে তাতে বিলম্ব ঘটবে। তবে দেরি হলেও নির্বাচন হবে কারণ নির্বাচন মাধ্যমে রাজনীতিবিদ সৃষ্টি হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “ভুল বা সঠিক যে কোনো ভাবেই নির্বাচিত হোক না কেন, নির্বাচিত ব্যক্তি খানিকটা হলেও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে।”
কিন্তু ৩৬ বছর বয়সী কাসাভা কিষাণী টেরিজা সিমা এরই মধ্যে সব আশা হারিয়েছেন। জুবা এবং ইয়েইর মধ্যবর্তী এলাকার বিধবা এ কিষাণী মনে করেন, রাজনৈতিক অন্তঃকলহে দক্ষিণ সুদানের অনেকের জন্যেই নানা নাটকের সৃষ্টি করেছে। চলতি বছরই একদল ব্যক্তি তাদের গ্রামে হামলা করেছিল। বন্দুকের একটা গুলি তার কুঁড়েঘর ছিদ্র করে তাঁর নয় বছরের ছেলেকে আহত করে। আক্রমণকারীরা কি বিদ্রোহী, ডাকাত না সেনাদলের সদস্য এখনো তা বের করতে পারেননি সিমা। তিন বছর আগে গ্রামেই নিহত হয়েছিল তার স্বামী সে কথা জানান তিনি।
দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার পক্ষেই ২০১১ সালে ভোট দিয়েছিলেন সিমা। কিন্তু এখন গভীর ভাবে হতাশ তিনি । "শান্তি বিরাজ করলে আমি স্বাধীনতাকে মেনে নেবো," তিনি বলেন। “শিশুর শিক্ষা, রাস্তাঘাট, অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোসহ সব সমস্যাই শান্তি বজায় থাকল সমাধান হবে। দক্ষিণ সুদান এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, মানুষ ভাগছে, তাদের সবকিছু লুটপাট হয়ে যাচ্ছে।”
"যখন যুদ্ধ হয়, তখন আর কিছুই থাকে না," তিনি যোগ করেন,"এবং আমরা দীর্ঘদিন ধরেই যুদ্ধে আছি।"
[ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে বাংলা রূপান্তর সৈয়দ মূসা রেজা]
আরো পড়ুন:
স্বাদহীন স্বাধীনতা: দক্ষিণ সুদানের ‘নষ্ট’ দশক
আমেরিকার ‘দেশ-গড়ার’ আরেক ব্যর্থতা দক্ষিণ সুদান