রাত জাগা এক অভিশপ্ত বদভ্যাস


সঞ্জয় দত্ত | Published: February 27, 2021 17:20:58 | Updated: February 28, 2021 13:40:59


রাত জাগা এক অভিশপ্ত বদভ্যাস

অভ্যাস এবং বদভ্যাসের পার্থক্য যাঁরা বোঝেন, তাঁরা সত্যিকার অর্থেই নিজেদের জীবন নিয়মিত ছকে ফেলতে পারেন। তবে দুঃখজনক সত্য হলো, বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশের কাছেই নিজেদের জন্য খুব দরকারি দৈনন্দিন রুটিন নেই। ফলে নতুন নতুন সমস্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। এ সব সমস্যাকে ছাপিয়ে যেটি ক্রমশ পোক্ত হচ্ছে, তার নাম ‘রাত জাগা’।
এই রাত জাগা নিয়ে আবার উঠতি বয়সী মহলে নানাবিধ তথাকথিত অত্যাধুনিক যুক্তিরও উদ্ভব হচ্ছে। এদের কেউ কেউ রাত জাগাকে স্রেফ ফ্যাশন বলে ভাবেন। কেউ কেউ রাতে না ঘুমানোর কারণ হিসেবে খুব অনায়াসে বলে ফেলেন, ‘আমি দিনে ঘুমোতে পছন্দ করি’। তবে এর বাইরে এমন অনেকেই আছেন, যারা কার্য সম্পাদনের জন্য রাতের নির্মল-নিশ্চুপ সময়টাকেই বেছে নেন।
কিন্তু রাত জাগা যে শারীরিক ও মানসিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয় তা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কোনো সংশয় নেই। আসুন জেনে নিই অতিরিক্ত রাত জাগার ফলে আমাদের কী কী ক্ষতি হয়, কোন ডিভাইসগুলো আমাদের স্বাভাবিক নিদ্রার গতি রোধ করে এবং এই বদভ্যাস কাটিয়ে ওঠার কী কী উপায় আছে।

রাত জাগলে কী ক্ষতি হয়?

একজন মানুষের সুস্থতার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। আমাদের দেহ পারস্পরিক বিনিময় সূত্র অবলম্বন করে। অর্থাৎ, আমরা যখন আমাদের শরীরের জন্য খুব দরকারি রাতের বিশ্রামটুকু কেড়ে নিই, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই আমাদের এই ব্যবস্থাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে আমরা শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগি এবং খুব তাড়াতাড়ি এর থেকে পরিত্রাণ পাই না।
ইউরোপিয়ান হার্ট জার্নালের ভাষ্যমতে, একজন ব্যক্তি যখন রাতে পাঁচ ঘণ্টার কম ঘুমান, তখন তাঁর হৃদ্‌যন্ত্র স্বাভাবিক কার্য সম্পাদনে ক্রমশ অক্ষম হয়ে পড়ে। এর ফলে করোনারি হৃদ্‌রোগ এবং হার্ট অ্যাটাকের মতো ভয়াবহ ঘটনাও ঘটতে পারে।
আমেরিকান একাডেমি অব স্লিপ মেডিসিনের তথ্যমতে, রাতে কম ঘুমানোর খেসারত হিসেবে একজন মানুষের মরণঘাতী ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে কলোরেক্টাল ক্যানসার, স্তন ক্যানসার এবং প্রোস্টেট ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এই বদভ্যাসের কারণে।
বর্তমান সময়ে খুব পরিচিত রোগের নাম ‘ডায়াবেটিস’। নিদ্রা ত্রুটি আমাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনাকেও বহুগুণ বৃদ্ধি করে।
আধুনিকায়নের ফলে, বর্তমান সময়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ছে বই কমছে না। কিন্তু ব্যবহার বৃদ্ধি স্কেলের সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ক্ষতি স্কেল। এই ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো আরও নানাবিধ সমস্যা উৎপাদনের পাশাপাশি আমাদের স্বাভাবিক ঘুম তৈরির প্রক্রিয়াতেও বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে।

কোন ডিভাইস আমাদের ঘুম কেড়ে নেয়?

আমাদের দেহাভ্যন্তরে একেকটি ঘড়ি বসানো আছে। এ ঘড়ি চব্বিশ ঘণ্টা নীতিতে তার কার্য সম্পাদন করে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ঘড়ি আমাদের দেহে কর্টিসোল নামক এক বিশেষ হরমোন তৈরির সিগন্যাল পাঠায়। উক্ত হরমোন আমাদের ভেতর ‘জাগানিয়া’ অনুভূতি উৎপাদনে সহযোগিতা করে। এর ফলে আমরা ঘুম থেকে উঠতে পারি। অন্যদিকে, সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেহ মেলাটোনিন নামক আরেকটি হরমোন নিঃসরণ শুরু করে, যা আমাদের নিদ্রানুভূতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
কিন্তু যখন আমরা অতিমাত্রায় সেলফোন বা কম্পিউটারে মনোযোগী হই, তখন এই উভয় হরমোন তৈরির প্রক্রিয়া নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। কেননা এসব ডিভাইস থেকে ব্লু লাইট বা নীল আলোকরশ্মি নির্গত হয়। এই নীল আলো আমাদের সহজাত দেহঘড়ির সমস্ত নিয়মকে ভেঙে দেয়। এর ফলে কর্টিসোল কিংবা মেলাটোনিন—এই দুই হরমোন তাদের স্বাভাবিক কার্যপ্রণালী চালিয়ে যেতে পারে না এবং একজন মানুষ ধীরে ধীরে নিদ্রাহীনতার দিকে ধাবিত হয়।
এছাড়াও যার শোয়ার ঘরে ইলেকট্রনিক বাতির আনাগোনা যত বেশি প্রবল, মেলাটোনিন হরমোন তৈরিতে সে তত বেশি পিছিয়ে।

উপরিউক্ত সমস্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে আমরা অনেকেই হয়তো কিছুটা চিন্তিত যে রাত জাগার ফলে আমাদের এত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমরা তার লাগাম টেনে ধরতে পারছি না—ব্যাপারটি চিন্তার তো বটেই। কিন্তু কিছু বিশেষ কৌশল বা নিয়ম মেনে চললে আমরা খুব দ্রুতই এ অভ্যাস থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।

সমাধান কী?

ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য সম্পর্কে আমরা সবাই কমবেশি জানি। প্রতিদিনের চেনা পানীয় চা কিংবা কফি ক্যাফেইন সমৃদ্ধ। এই ক্যাফেইন মানুষের নিদ্রাহীনতার আরেকটি বিশেষ কারণ। যে ব্যক্তি অতিমাত্রায় চা-কফি পান করে, তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই রাত জাগার অভ্যাস জন্ম নিতে পারে।
সন্ধ্যার পর পরই ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য পরিত্রাণ করলে খুব দ্রুত এ অভ্যাস কাটিয়ে ওঠা যায় ৷

ধূমপান দিনের যেকোনো সময় ক্ষতিকর, তাতে সন্দেহ নেই। তবে রাতের বেলায় তা আরও সমস্যার সৃষ্টি করে। ঠিক এভাবেই, রাতে ধূমপান ব্যক্তিকে রাত জাগায় বিশেষভাবে অভ্যস্ত করে তোলে।

মনোজগতে শীতলতা আনতে পারে, এমন বইগুলো ব্যক্তিকে রাত জাগা থেকে পরিত্রাণ দিতে পারে। ঘুম হয় না বলে অনেকেই জবরদস্তি করে এ অভ্যাস কাটিয়ে ওঠার একটা প্রয়াস খোঁজেন। কিন্তু বিষয়টি বরং এ বদভ্যাসকে পোক্ত করবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে ওঠে। তাই, এ অভ্যাস কাটিয়ে উঠতে স্থির থাকতে হবে।

প্রতি রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ের গোসল করলে এ বদভ্যাস থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অনেকেই আছেন, যারা সব ধরনের কাজের ক্ষেত্রেই বিছানা ব্যবহার করে থাকেন। সব কাজে বিছানা ব্যবহার করা, এ অভ্যাসের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

রাত জাগার বদভ্যাস কাটিয়ে উঠতে চাইলে দিনে ঘুমানো থেকে বিরত থাকতে হবে। অথবা ঘুমের জন্য একটি সময় স্থির করে নেওয়া যায়। যেমন, যদি আপনি রাত ঘুমের ক্ষেত্রে সঠিক রুটিন পালন করতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে সকালবেলা জাগবার সময়টুকু সঠিক করে নিন। এতে করে এই বদভ্যাস কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।


সঞ্জয় দত্ত লেখক বর্তমানে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে সম্মান চতুর্থ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। ইমেইল sonjoy. bd. golpokar@gmail.com

Share if you like