Loading...

ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের খুঁটিনাটি

| Updated: April 17, 2021 20:56:13


ছবিঃ ইন্টারনেট ছবিঃ ইন্টারনেট

১৯৬৮ সাল। সে বছরেরই কোনো এক সন্ধ্যাবেলা। নিউইয়র্ক শহরে চলছে বিশ্বমেলা। তবে সে বিশ্বমেলাটি আর সব বারের মতন সাধারণ ছিল না। সমগ্র পৃথিবীর নজর আটকে ছিল নিউইয়র্ক শহরে। কারণ সেবার বিখ্যাত টেলিসেবা কোম্পানি টিঅ্যান্ডটি বাজারে আনতে চলেছিল বিশ্বের প্রথম ভিডিও ফোন। গ্রাহামবেলের টেলিফোনের সঙ্গে কমবেশি সবাই পরিচিত ছিল তখন। কিন্তু কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্তের মানুষটিকেও দেখা যাবে, এ ছিল অদ্ভুত কল্পনা, যেন কল্পবিজ্ঞান! সেই সন্ধ্যায় টিঅ্যান্ডটি মেলায় উপস্থিত দর্শকদের ১০ মিনিট করে ভিডিও কলে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়।  তবে প্রতিদিনের পৃথিবীতে টিঅ্যান্ডটি’র ভিডিও ফোন খুব একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তার অবশ্য কিছু কারণ ছিল। প্রথমত এটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সেটআপ এবং কল সংযোগ করা বেশ কঠিন। তাই ভিডিও ফোন সাধারণ মানুষের কল্পনাতেই থেকে যায়। ওই সময়ের বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশনে উঠে আসে ভিডিও কলিংয়ের কথা।

১৯৯০ এর দশকে আসে মহাকাঙ্ক্ষিত ইন্টারনেট বা ইন্টারনেট প্রোটোকল। এই ইন্টারনেটই ভিডিও কনফারেন্সিংকে কল্পবিজ্ঞানের জায়গা থেকে নিয়ে আসে সাধারণ মানুষের নাগালে। ইন্টারনেট আসার পর প্রথম পদক্ষেপটি নেয় বিখ্যাত কম্পিউটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আইবিএম। তারাই প্রথম ডেস্কটপ ভিত্তিক ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যার তৈরি করে। তার ধারাবাহিকতায় অ্যাপল তাদের ম্যাকিনটোস ডেস্কটপে প্রথম একটি সফটওয়্যার তৈরি করে, যেটির নাম ছিল সিইউ-সি মি (CU-see me)। ৯০ দশকে সবচেয়ে জনপ্রিয় অ্যাপের তালিকায় ছিল এটি। তবে এর প্রধান সমস্যা ছিল, এতে শুধু ভিডিও দেখা যেত, কথা বলতে হতো সাধারণ টেলিফোন ব্যবহার করে।

তবে অ্যাপলকে টেক্কা দিতে ২০০০ সালের মাঝামাঝি পলিকম নামক একটি কোম্পানি বাজারে ছাড়ে তাদের ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপ ‘ভিউ স্টেশন’। যেটি ছিল আগেকার যেকোনো সিস্টেমের থেকে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত এবং তুলনামূলক সস্তা। ফলে তারা প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলায় আয় করে!

২০০০ সাল থেকেই মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। মূল কারণগুলো ছিল সস্তা ওয়েবক্যাম, ফ্রি সফটওয়্যার এবং বিস্তৃত ব্রডব্যান্ড সংযোগ। ২০০৩ সালের দিকে তো প্রায় প্রত্যেকটি চ্যাটিং সফটওয়্যার ভিডিও কলের সুযোগ দিত, ২০০৫ সালে স্কাইপ তাদের ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা চালু করে। সেই সময় ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভিডিও কলিং তরুণ সমাজের ভেতর দারুণ জনপ্রিয়তা পায়, তারা এটাকে প্রতিদিনের জীবনে যোগাযোগের নতুন এক মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে।

আজকের এ লেখা ইতিহাস দিয়ে শুরু হলেও এর শেষটা হবে বর্তমানে। মহামারি পরিস্থিতিতে আজকাল সকল প্রকার গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনা-সভা, ব্যক্তিগত যোগাযোগের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে এই ভিডিও কনফারেন্স। চলুন জেনে নেওয়া যাক, বর্তমানে ভিডিও কনফারেন্সিং বা ভিডিও চ্যাটিংয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু সেবার বিষয়ে।

স্কাইপ

স্কাইপ মাইক্রোসফটের নিজস্ব ভিডিও কলিং অ্যাপ। এর যাত্রা শুরু হয় ২০০৩ সালে, তখন সফটওয়্যারটি শুধুমাত্র অডিও কলিং এবং ভিওআইপি বা ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল সেবা দিয়ে থাকত। ২০০৫ সাল নাগাদ স্কাইপ তাদের ভিডিও কলিং সেবা চালু করে। সেই সময় থেকে তারা তাদের জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ন রেখেছে। এর অন্যতম বড় কারণ, সেবাটি স্কাইপ থেকে স্কাইপ সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে নেওয়া যায়। তবে শুধু মোবাইল ফোন বা ল্যান্ড লাইনে ফোন করতে চাইলে নির্দিষ্ট কিছু ফি দিতে হবে। বর্তমানে সেবাটি উইন্ডোজ, ম্যাক, অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন সহ বিভিন্ন পরিসরে উপলভ্য।

ফেসবুক ভিডিও কলিং

মোটামুটি জন্মলগ্ন থেকেই ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি। প্রথমদিকে ফেসবুকের বন্ধুদের মধ্যে টেক্সট চ্যাট বা লিখে কথা বলা যেত। কিন্তু কিছুটা দেরিতে হলেও ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে কিছু কিছু দেশের জন্য পরীক্ষামূলক ভাবে ভয়েস এবং ভিডিও কলিংয়ের অপশন চালু করে প্রতিষ্ঠানটি। সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বব্যাপী ফেসবুক তাদের ভিডিও কলিং ফিচার উন্মুক্ত করে দেয়। বর্তমানে ফেসবুক সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে ভিডিও কলিং সেবা দিচ্ছে। সর্বোচ্চ ৫০ জন এক সঙ্গে কোনো ভিডিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে পারে।

জুম

বর্তমানে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা হচ্ছে জুম। জুম কমিউনিকেশন লিমিটেড একটি যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, যার সদর দপ্তর স্যান হোসে, ক্যালিফোর্নিয়াতে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে তাদের ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা চালু করে। সাধারণ বা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য জুম সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। এতে একটানা সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট ভিডিও কনফারেন্স করা যায়। তবে ব্যবসায়িক এবং এন্টারপ্রাইজের জন্য রয়েছে জুমের বিভিন্ন পেইড সেবা। অন্যান্য ভিডিও কনফারেন্সিং অ্যাপের মতো জুম এখন অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন, পিসি এবং ম্যাক পরিসরে উপলভ্য।

গুগল মিট

গুগল মিট বর্তমানে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাজের জন্য সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি সেবা। গুগল ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এটি চালু করে। বর্তমানে সেবাটি সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে এবং ৪০ জন ব্যক্তি এক সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে পারে। গুগল মিট অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহার করা যায়। তবে গুগল মিটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, যেকোনো ডিভাইসের শুধুমাত্র ব্রাউজার ব্যবহার করে ভিডিও কনফারেন্সিং চালু করা যায় এবং অংশ নেওয়া যায়।

বিগ ব্লু বাটন

এটি একটি ওপেন সোর্স ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম, যা মূলত অনলাইন লার্নিং বা ই-লার্নিংকে উদ্দেশ্য করে বানানো হয়েছে। ওপেন সোর্স সফটওয়্যারের অর্থ হচ্ছে, সফটওয়্যারটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পাওয়া যাবে এবং ব্যবহারকারী তার ইচ্ছামতো এতে পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন আনতে পারেন। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে বিগ ব্লু বাটন তাদের যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে সফটওয়্যারটি শুধুমাত্র লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমের জন্য উপলভ্য।

হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলিং

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক এই অ্যাপটির স্বত্বাধিকারী ফেসবুক। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন এবং উইন্ডোজ ফোনে ভিডিও কলিং সেবা চালু করে। হোয়াটসঅ্যাপ ভিডিও কলিং সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে পাওয়া যায়, তবে গ্রুপ ভিডিও কলে সর্বোচ্চ ৮ জন অংশগ্রহণ করতে পারে। আপাতত হোয়াটসঅ্যাপ শুধুমাত্র মোবাইল প্লাটফর্মগুলোর জন্য উন্মুক্ত। উইন্ডোজ ভিত্তিক কম্পিউটারে বা যেকোনো ব্রাউজারে হোয়াটসঅ্যাপ ওয়েবে কাজ করা যায়। কিন্তু ভিডিও কলিং শুধুমাত্র মোবাইলে সীমাবদ্ধ।

এছাড়া আরও অনেক ভিডিও কলিং অ্যাপ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের জন্য উপলভ্য রয়েছে। সবচেয়ে আশার কথা হলো, এর বড় একটি অংশ ব্যবহারকারীদের বিনামূল্যে তাদের সেবাটি উপভোগ করার সুযোগ দেয়। প্রযুক্তির এই অসামান্য দান আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে আমরা ভালো করেই বুঝতে পেরেছি। ভিডিও কনফারেন্সিং প্রযুক্তি যে আমাদের জীবনকে একধাপ সহজই শুধু করেছে, তা নয়। এটি আমাদের অনেক সময় বাঁচিয়েছে এবং এ কথা বললে ভুল হবে না যে, হাজার মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে করোনার সংক্রমণ থেকে।

Share if you like

Filter By Topic