Loading...

বাঁচানো গবাদিপশু টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে বানভাসিরা

| Updated: July 07, 2022 19:21:39


বাঁচানো গবাদিপশু টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে বানভাসিরা

বানের জল প্রবল তোড়ে পথঘাট পেরিয়ে ঘরেই যখন গলা অবধি উঠছিল, তখন নৌকায় চারটি গরু নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে ছুটছিলেন আক্তার হোসেন ও তার ভাই।

কোমরপানি হওয়া সড়কের উপর দিয়ে ৭-৮ মিনিট নৌকা বাওয়ার দূরত্বে ছিল আশ্রয় কেন্দ্র। কিন্তু মাঝপথে স্রোতের ধাক্কায় উল্টে যায় তাদের নৌকা। গরু রেখেই সাঁতরে প্রাণে বাঁচতে হয় আক্তারদের।

এর মধ্যে দুটি গরু বাঁধন ছিঁড়ে সাঁতরে পার হতে পারলেও অন্য দুটির সলিল সমাধি হয়। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

পাঁচদিন পর রাস্তা থেকে নৌকা আর দুই গরুর মরদেহ পান সুনামগঞ্জ সদরের মাইজবাড়ির এসএসসি পরীক্ষার্থী আক্তার।

মরা গরুর মধ্যে একটি ছিল ২-৩ মাসের বাছুর আর অন্যটি বড় ষাঁড়। এটি ঈদের সময় বেশি দামে বেচার ইচ্ছা ছিল আক্তারদের।

আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মাসখানেক আগে ওই ষাঁড়ের দাম উঠেছিল ৩৯ হাজার টাকা। কিন্তু কোরবানি ঈদের সময় বেশি দামের আশায় সেটা ধরে রেখেছিলেন তারা।

নৌকা বানিয়ে আর গরু-ছাগল পালন করে কোনোমতে সংসার চলে আক্তারদের। বিক্রিযোগ্য ষাঁড়ের পাশাপাশি বাছুর হারা হয়েছে তাদের আরেকটি দুধেল গাভী।

আক্তারদের ঈদের খরচ মেটানোর অবলম্বন যাওয়ার মতো করে অনেকের গবাদিপশু ভেসে গেছে এবারের বন্যায়।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাব বলছে, বন্যায় ৪২২টি গরু, ৩৭টি মহিষ, ৬৬৯টি ছাগল ও ৫১৪টি ভেড়া মারা গেছে। সলিল সমাধি হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার ৮৮৬টি হাঁস-মুরগির।

খামারে জমা তিন দিনের বানের পানিতে ১২টি গরুর মধ্যে ৩টি, আটটি খাসির মধ্যে ২টি এবং দেড় শতাধিক মুরগি মারা গেছে নেত্রকোণার ধর্মপাশা উপজেলার আজনাত ডেইরি খামারের।

সমুদয় সঞ্চয় দিয়ে বড় আকারের ওই খামার গড়েছিলেন ব্যবসায়ী আবুল কাহার ও স্কুল শিক্ষক প্রভা আক্তার দম্পতি।

বানের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের খামারের অবকাঠামো। বিপুল পরিমাণ খড় আর ঘাস নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাকি গরু-ছাগল আর মুরগিকে বাঁচাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদেরকে।

ধর্মপাশার সেলবরষ ইউনিয়নের প্রভা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যে তিনটি গরু মারা গেছে তার মধ্যে বড় ষাঁড়ের দাম কয়েক দিন আগে উঠেছিল ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা।

 “আরেকটু বেশি দামের আশায় ধরে রাখছিলাম। কোরবানির সময় সেল দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আল্লাইতো রাখছে না।”

গরু বেচে নিজেদের কোরবানির খরচ মেটানোর পাশাপাশি খামারের অবকাঠামো আরও বড় করার পরিকল্পনা ছিল প্রভাদের। কিন্তু এখন খামার কীভাবে ধরে রাখবেন, সেই দুশ্চিন্তা্ সঙ্গী।

প্রভা বলেন, “প্রতিবার এক গরু দিয়ে কোরবানি দিতাম আমরা। এবার অন্যদের সাথে ভাগে দিচ্ছি। সাত ভাগের কোরবানি হবে, আমাদের দুইভাগে ৩০-৩২ হাজার টাকা লাগবে। অথচ গতবার ৫০ হাজার টাকা দামের গরুর কোরবানি দিয়েছি।”

খামারে কাজের লোক দুজন থেকে একজনে নামিয়ে এনেছেন প্রভারা; ঠিকমতো খাবার না পেয়ে গবাদিপশুর ওজন কমে গেছে বলে জানান তিনি। সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা পেলে ঘুরে দাঁড়ানোর কষ্ট লাঘব হতো বলে মনে করছেন এই স্কুল শিক্ষক।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্য বলছে, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর উপজেলার প্লাবিত ১০টি ইউনিয়নে ৫০ হাজার ৪৭টি গরু, ১ হাজার ২০টি মহিষ, ১২ হাজার ১৪০টি ছাগল, ১১ হাজার ২৫০ টি ভেড়া, ৫৪ লাখ ২ হাজার ৫৪৭ টি মুরগি ও ৩ লাখ ৭২ হাজার ৭২৮ টি হাঁস রয়েছে।

এর মধ্যে ১৫টি গরু, ১০ ছাগল, ৩টি ভেড়া, ১ হাজার ৫০০টি মুরগি ও ৪ হাজার ১৩৫টি হাঁসের সলিল সমাধি হয়েছে ওই দুই উপজেলায়।

ওই দুই উপজেলায় গবাদি পশুর ১৫০টি খামার রয়েছে, যার মধ্যে সরকার নিবন্ধিত ১৩টি। বন্যায় গবাদি পশুর মৃত্যু, দানাবার খাবার, খড়সহ খামারের অবকাঠামোগত প্রায় ৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন্যার কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে থেকেই এবার খড়ের সঙ্কটে ছিল সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণাসহ বিস্তীর্ণ হাওরাঞ্চলের মানুষ।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার মানুষ দুই দফায় আগাম বন্যার কারণে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারেননি; কাঁচা ধান কাটায় খারাপ হয়েছে খড়ের মান।

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর ভেসে যাওয়া থেকে বাছা খড় সড়কের উপর শুকাতে দেখা গেছে সুনামগঞ্জ সদর, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভপুর ও দোয়ারাবাজারের বিভিন্ন এলাকায়।

ধান ঘরে তুলতে না পারায় আট হাজার টাকা দিয়ে গরুর জন্য অন্য এলাকা থেকে খড় কিনে এনেছিলেন তাহিরপুর উপজেলার গোলাবাড়ি গ্রামের শুকিলা বেগমরা। বন্যার তোড়ে তাদের ঘর তননছ হয়েছে, নষ্ট হয়েছে সেই কেনা খড়ও।

নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির বর্ণনা দিতে গিয়ে শুকিলা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা কী আর বলব, গরুর খেরও নষ্ট হয়ে গেছে পানিতে। এখন গরুরে কী খাওয়ামু?”

১৫-১৬টি জেলায় বন্যার প্রভাব কোরবানির গরুর হাটে থাকলেও বাজারে চাহিদার ঘাটতি ঈদের আগে চোখে পড়ছে না বলে জানান বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাদিক এগ্রোর মালিক শাহ ইমরান হোসেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অনেকগুলো জেলায় বন্যা হয়েছে, তার প্রভাব তো বাজারে কিছুটা আছেই। তবে, সাপ্লাইয়ের ঘাটতি নাই। বরং বন্যাদুর্গতরা গরু বিক্রি করে দিতে বাধ্য হওয়ায় সাপ্লাই বেড়েছে। এখন বিক্রি কম মনে হচ্ছে। আরও কয়েকদিন সামনে আছে, আশা করি জমবে হাট।”

Share if you like

Filter By Topic