Loading...

বংশগত রোগ সারবে, সেরে উঠবে দেহ-প্রতিরক্ষাজনিত অসুখও!

| Updated: October 27, 2021 17:24:38


বংশগত রোগ সারবে, সেরে উঠবে দেহ-প্রতিরক্ষাজনিত অসুখও!

কোভিড-১৯কে এমআরএনএ বা ম্যাসেঞ্জার আরএনএ চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে পৌষ মাস হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ২০১৩ সালে চীনে এইচ৭এন৯ বার্ড ফ্লু ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। অনলাইনে এই ভাইরাসের বংশগতির অনুক্রম প্রকাশের মাত্র আট দিনের মাথায় টিকা বের করে মার্কিন কোম্পানি নোভার্টিস বিশ্বকে চমকে দেয়। এর আগে এতো দ্রুত কোনো টিকা বের হয়নি। তবে রোগটি তাড়াতাড়ি বিদায় নেওয়ায় নতুন টিকা পরীক্ষার মওকাই সেবারে মেলেনি।

মুনাফার অবকাশ নেই মনে করে তখন এমআরএনএ টিকা গবেষণা থেকে পাততাড়ি গোটাল ওষুধ-বাণিজ্য জগতের দিকপালরা। মডার্না এবং বায়োএনটেকের মতো ছোট দুই কোম্পানি অবশ্য কপাল ঠুকে লেগে রইলো এ গবেষণায়। ২০২০ সালে করোনা প্রকোপ বিশ্বমারি হয়ে দেখা দেওয়ার পর টনক নড়ল সবার। দ্রুত টিকা বের করা তাগিদে জেরবার জগতকে আশ্বস্ত করতে এগিয়ে এলো ফাইজার/বায়োএনটেক। গত বছরের আগস্টেই মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের প্রথম অনুমোদন পেল তাদের তৈরি কোভিড-১৯-এর এমআরএনএ টিকা।

রাতারাতি সবার নজর পড়তে শুরু করল এ দিকে। ২০১৮ সালে এ খাতে মাত্র দু’টি টিকার পরীক্ষা হলেও চলতি বছরে এ পর্যন্ত ৭১টি এমআরএনএ টিকার পরীক্ষা চলেছে। এ সব টিকার বেশির ভাগই হলো সংক্রমণ রোগ ঠেকানোর জন্য। ১৬ অক্টোবরের ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাপ্তাহিক নিউ সায়েন্টিস্টের প্রচ্ছদ কাহিনীতে এ বিষয় তুলে ধরেন বিজ্ঞান সাংবাদিক মাইকেল লি পেইজ।

এমআরএনএ টিকা নিয়ে তিন উজ্জ্বল আশার বাতি জ্বলে উঠছে – এমনটি ভাবছেন বিশেষজ্ঞজনেরা। যক্ষ্মার জন্য এখন বিসিজি টিকা ব্যবহার হয়। এমআরএনএ দিয়ে এর চেয়ে ভালো বিকল্প টিকা পাওয়া যাবে। দ্বিতীয়, এইডস সৃষ্টিকারী ‘হিভ’ ভাইরাস থেকে শুরু করে লোকমুখে প্রচলিত জ্বরঠোস বা  জ্বরফোস্কাসহ নানা অনর্থ সৃষ্টিকারী হার্পেসের মতো অনেক ভাইরাসেরই কোনো টিকা আজ অব্দি বের হয়নি। নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিতে এসব রোগের টিকাও বের হবে। তৃতীয়ত, কোভিড-১৯’এর মধ্য দিয়েই বিশ্বমারির তাণ্ডব শেষ হবে না। বরং আগামীতে আসবে আরো মহামারী। সেই আগামী অজানা বিশ্বামারিকে ঠেকানোর টিকাও একইভাবে বের করা সম্ভব হবে বলে চিন্তা করছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা।

বিকল্প এবং কার্যকর টিকার কথা উঠলে সবার আগে নাম আসবে সর্দিজ্বর বা ফ্লু-র কথা। মৌসুমি এসব রোগের টিকা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মাত্র কার্যকর। কারণ হলো, এই টিকার কাজ ফ্লু মৌসুমের অন্তত আট মাস আগে শুরু করতে হয়। টিকা আসতে আসতে ভাইরাসেরও নতুন প্রজাতি এসে যায়। এভাবেই টিকার কার্যকারিতা ঠেকিয়ে দেয় ভাইরাস।

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে

এমআরএনএ টিকা নিয়ে কথা বলতে গেলে যদি কেউ গুণগুণ করে গেয়ে ওঠেন, ‘তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে,’ তবে তাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নোরবার্ট পার্ডি বলেন, এমআরএনএ টিকার আরেকটি সুবিধা হলো এর নমনীয়তা বা পরিবর্তনযোগ্যতা। এক সাথেই ১০ বা তারচেয়ে বেশি রোগের বিরুদ্ধে এরকম টিকা দেওয়া সম্ভব। এভাবে সর্দি-জ্বরসহ অনেকগুলো রোগের জন্য একটি টিকা তৈরির কাজ করছে মডার্না।

এদিকে আমিষ দিয়ে আজকাল কয়েকটি সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী চিকিৎসা হয়। এধরণের চিকিৎসায় সাধারণত এন্টিবডিজ বা প্রতিরক্ষিকাগুচ্ছ ব্যবহার হয়। তবে বিশেষ রোগ-পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এগুলোকে খুবই হিসাব-নিকাশ করে সুনির্দিষ্টভাবে কেটেছেটে তৈরি করা হয়। এন্টিবডিজ বা প্রতিরক্ষিকাগুচ্ছ কী, সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। হ্যাঁ, শরীরে যখন ব্যাধি সৃষ্টিকারী হানাদাররা ঢুকে পড়ে তখন তাদের সামাল দেওয়ার জন্য যে বাহিনী দেহপ্রতিরক্ষা পাঠায় সে বাহিনীর সদস্যই হলো প্রতিরক্ষিকা। চিকিৎসার অংশ হিসেবে, পরিব্যাপ্ত বা মিউট্যান্ট ক্যান্সার কোষরাজিতে সেঁটে থাকার জন্য যদি প্রতিরক্ষিকাগুচ্ছ তৈরি করা যায়, তাহলে দেহ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগ পাবে।

ভাইরাস বা সংক্রমণ শরীরের জন্য বিপদ হয়ে দেখা দেয় তখন দেহ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সাড়া দেয়। এটি প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থার সাড়া বা ইমিউন রেসপন্স নামে পরিচিত। কখনো কখনো দেহ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মাত্রা ছাড়িয়ে সাড়া দিতে থাক। সুস্থ কোষ এবং কোষকলা এই প্রতিক্রিয়ায় ধরা পড়ে। একে দেহ-প্রতিরক্ষার রোগ বা অটোইমিউন ডিজিজ বলা হয়। আমিষ চিকিৎসার করে এরকম সাড়া দেওয়াকে কমিয়ে আনা যেতে পারে।

মাইগ্রেন থেকে আরম্ভ করে সংক্রমণ পর্যন্ত নানা রোগের চিকিৎসায় এখন কিছু কিছু প্রতিরক্ষিকাভিত্তিক ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু এসব কোনো ওষুধই সস্তা নয়। প্রচণ্ড দামি। তৈরি করতেও অনেক সময় লাগে। নিয়মিত এমন ওষুধ নিতে হলে খরচের খাত কেবল ভারীই হতে থাকবে।

বৃক্ক বা কিডনির মারাত্মক রোগ এএইচইউএস। প্রতিরক্ষিকা অ্যাকুইলিজম্যাব দিয়ে এ রোগের চিকিৎসা করা যায়। তবে বছরে খরচ হবে প্রায় তিন লাখ পাউন্ড স্টারলিং বা  চার লাখ ডলারের কিছু বেশি।

আশার কথা হলো যদি এমআরএনএ দিয়ে ওষুধ তৈরির পর্বটি রোগীর শরীরের ভেতরেই সারা যায় তবে একই চিকিৎসা এর চেয়ে অনেক সস্তায় করা যাবে। ওই খরচের ভগ্নাংশ হয়তো ব্যয় হবে। আর এধরণের নতুন ওষুধ তুলনামূলকভাবে দ্রুততর তৈরি করা সম্ভব। হৃদরোগে ক্ষতিগ্রস্ত হৃদযন্ত্রের পেশিতে তৈরি করা যাবে রক্তবাহী নালী। অর্থাৎ পেশি সেরে উঠবে। একইভাবে, ক্ষত চিকিৎসাও চলবে। এ নিয়ে পরীক্ষা চলছে।

অবশ্য সমস্যা আছে এখানেও। দেহকে সরাসরি প্রতিরক্ষিকা তৈরি করতে বলা আর টিকা দেওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। টিকাতে অতি অল্প পরিমাণে ভাইরাসীয় আমিষের প্রয়োজন পড়ে। দেহের একটি অংশেই এ আমিষের উৎপাদন সীমিত থাকাই যথেষ্ট। বহিরাগত আমিষ সেখানে প্রদাহ তৈরি করবে। এ কাজের জন্য কাঁধের পেশি আরামদায়ক এবং নিরাপদ। অন্য চিকিৎসায় অনেক বেশি মাত্রায় এমআরএনএরাজিকে ইনজেকশনের মাধ্যমে দেহে ঢোকাতে হয়। আর এর সবই যকৃতের কোষরাজি টেনে নেয়। সেখানেই কাঙ্ক্ষিত আমিষ উৎপাদিত হয়। আর সেগুলো রক্তধারায় যেয়ে মেশে।

এতে আমিষভিত্তিক যে কোনো ওষুধ তৈরির জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে যকৃত বা লিভারই জৈবচুল্লিতে রূপান্তরিত হয়। এখনো এই চিকিৎসা পদ্ধতির সূচনাপর্বই চলছে। ২০১৯ সালে চিকনগুনিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষিকা তৈরিতে এ পদ্ধতিতে সাফল্য পাওয়া যাওয়ার খবর শোনা গেছে। মডার্না এমন চিকিৎসা পদ্ধতির পরীক্ষায় এগিয়ে আছে। কেবল প্রতিরক্ষিকা নয় বরং যে কোনো আমিষই প্রযুক্তিতে তৈরি সম্ভব বলে বলা হচ্ছে। এ বছরের আগস্টে অটোইমমিউন বা দেহ-প্রতিরক্ষা জনিত রোগ সারিয়ে তুলতে আমিষ তৈরির পরীক্ষায় নেমেছে একই কোম্পানি। এখানেও এমআরএনএ’র মাধ্যমে আমিষ তৈরির নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। একই সাথে বংশগত রোগ সারিয়ে তোলার পরীক্ষাও এগিয়ে চলছে। এ ক্ষেত্রে ত্রুটিযুক্ত একটি এনজাইমকে বদলে ভালো এনজাইম লাগিয়ে দেওয়া হবে।

পরীক্ষা সফল হলে এমন চিকিৎসা পদ্ধতির বিস্ফোরণ ঘটবে। দেহপ্রতিরক্ষা এবং বংশগতির সঙ্গে জড়িত রোগের চিকিৎসার নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। কোটি কোটি রোগীর কঠিন জীবনে নামবে আরামের নরম ছোঁয়া।

তখন আমিষ দিয়ে চিকিৎসার জন্য অনেক কম ইনজেকশন, অন্তঃপ্রবেশ  বা ইনফিউশনের দরকার পড়বে। একবার এমআরএনএ দেওয়া হলেই কয়েকদিন ধরেই আমিষ উৎপাদন চালিয়ে যাবে দেহ। এ ছাড়া, রাসায়নিক ভাবে এমআরএনএ’র তৎপরতার মেয়াদ বাড়ানো সম্ভব হবে। তাতে উৎপাদনের সময় আরো বাড়বেই।

মস্তিষ্ক বা হাড়ের মজ্জার মতো বিশেষ কোষকলারাজি বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে যদি সুনির্দিষ্ট ভাবে এমআরএনএ পৌঁছে দেওয়া যায় তবে সোনায় সোহাগা হবে। কোনো কোনো কোষকলাগুচ্ছ (টিস্যু)’এর বিশেষ কোষরাজিতে কার্যকর আমিষ না থাকায় দেখা দেয় বংশগত অনেক রোগ। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে আমিষ পৌঁছানো কঠিন। সরাসরি ইনজেকশন না দিয়ে এমনটা করা খুবই কঠিন বলে জানান কিউলিস।

এ সমস্যা কাটাতে ভাইরাসের সহায়তা নেওয়ার কথা ভাবছেন বিজ্ঞানীরা। সব ভাইরাস দেহের সবস্থানে হামলা করে না। বিশেষ বিশেষ ভাইরাস দেহের কেবল বিশেষ বিশেষ কোষকলার ওপর হামলা করে। এখন যদি এমন একটা ভাইরাসের খোলস ঠিক রাখা হলো। আর ভেতরের উপাদান খালি করে সেখানে এমআরএনএ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো – ব্যাস কেল্লা ফতে। অর্থাৎ খামের ওপরের লেখা ঠিকানা ঠিকই রইল কেবল ভেতরের চিঠিটাই বদলে দেওয়া হলো। বা ইমেইলের ঠিকানা ঠিক রেখে ভেতরের বার্তা বদলে দেওয়া হলো! এতে চিঠি বা ইমেইল নিজ ঠিকানায় পৌঁছানোর আর কোনো বাধাই রইল না। তবে চিঠির বা ইমেইলের নির্দেশ যে বদলে দেওয়া হয়েছে তা আর বুঝতে পারবে না প্রাপক দেহ।

এখানে প্রধান সমস্যা হলো, ভাইরাসের খোলস বা খালি ভাইরাসও দেহপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থার হামলা এড়াতে পারে না। প্রথমবার পারলেও, দ্বিতীয় দফায় সে সুযোগ আর দেবে না শরীর। তবে সুখবর হলো, এরই মধ্যে মানুষের আমিষ দিয়ে ভাইরাসের খোলস বানান গেছে! এ খবরে আশাবাদের রংমহলের সব ঝাড়বাতিই জ্বলে উঠছে। আজ বা আগামীকাল হয়ত সে চিকিৎসা শুরু হবে না, সত্য। কিন্তু চলার পথ যখন পাওয়া গেছে তা ধরে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আসবে সফলতা। আশাবাদী হওয়ার মতোই খবর।

[দ্য নিউ সায়েন্টিস্ট অবলম্বনে]

আরো পড়ুন: শরীরই হবে ওষুধের কারখানা!

Share if you like

Filter By Topic