Loading...

প্রজ্ঞা পরামর্শে খনার বচন

| Updated: May 08, 2021 12:57:10


প্রজ্ঞা পরামর্শে খনার বচন

গুনগুন করে গেয়ে ওঠা 'যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলে না মোরে’ অথবা কারো গলাবাজির বিপরীতে শুনিয়ে দেয়া 'চোরের মায়ের বড় গলা'– আজও বাঙালির মুখে মুখে ফেরা এসব কথার পেছনে জড়িয়ে থাকা নামটি হয়তো অনেকেরই জানা নেই।

বাংলা সাহিত্যের এসব অমর কিছু সৃষ্টির পেছনে থাকা স্রষ্টার নাম খনা। শুধু এসব চরণ বা সাহিত্যই নয়, বরং এই বিদূষী জ্যোতিষী শত শত বছর ধরে পরিচিত আর আলোড়িত তার বুদ্ধিদীপ্ত নানা পরামর্শ-উপদেশ ও বিধানের জন্য। যা বাঙালি পরম নিষ্ঠায় মেনে চলেছে 'খনার বচন' হিসাবে।

খনার বচনের রচনাকাল সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত দ্বিতীয় বিক্রমাদিত্যর রাজত্বকালে। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি বাস করতেন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের দেউলি (তৎকালীন চন্দ্রকেতু) গ্রামে। পিতা অনাচার্য ছিল রাজা চন্দ্রকেতুর মন্দিরের সেবাইত।

ঐতিহাসিক রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বর্ণনায় “চন্দ্রকেতু গড় যে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে, তা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়, স্থানটি ভারতের অতি পুরাতন স্থানগুলির অন্যতম। শুধু এই জায়গাটি খনা এবং মিহিরের বসবাসের কারণে সুপ্রাচীন স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়নি। এটাকে অনেকে তীর্থস্থান হিসেবেও অভিহিত করেছেন।”

কখনো বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের স্ত্রী, কখনো সিংহল রাজ্যের রাজকন্যা, কখনো দৈত্য-দানবের কাছে বেড়ে ওঠা ও তাদের থেকে জ্যোতিষশাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করাসহ খনাকে নিয়ে অজস্র রোমাঞ্চকর গল্প-কাহিনী ছড়িয়ে আছে মানুষের মাঝে। তবে ১৯০৬ সালে প্রকাশিত ‘আর্কিওলজি অব ইন্ডিয়া’ প্রতিবেদন অনুসারে খনাকে গুপ্তযুগের রমণী এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণার বাসিন্দা, উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্নের অন্যতম রত্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানী বরাহের পুত্রবধূ ও মিহিরের স্ত্রী হিসাবেই উল্লেখ করা হয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রধান লং হাস্ট ইতিহাসে প্রাপ্ত তত্ত্বাবলি থেকে এ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেন।

বহুল প্রচলিত ধারণা হলো, পুত্রবধূর জ্যোতিষচর্চার নৈপুণ্যে নিজের জ্যোতিষশাস্ত্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছিল বরাহের। বিশেষত রাজা বিক্রমাদিত্যর সামনে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন এ দেশবরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তার চেয়েও অনেক নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী কবি খনা কবিতা করে বলে যেতেন মুখে মুখে, হয়ে উঠছিলেন রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রিয়পাত্র ও রাজসভার অনন্য অংশ। খনার সেই বচনভাণ্ডার নষ্ট করতে বরাহ-মিহির জিভ কেটে নেন খনার। খনার বচনে লৌকিকতা আর ঘোর বাস্তবতার প্রকাশ এবং সেই সময়ে চার্বাক মতের বহুল প্রসারের দরুন কারো বিশ্বাস, খনা ছিলেন চার্বাকের অনুসারী নাস্তিক। আবার কারো মতে, খনার বচনে ব্রাহ্মণবিদ্বেষ এবং তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ভিক্ষুণীর লোকপ্রচার বরাহ মেনে নিতে পারেননি। তাই শ্বশুর ও স্বামী মিলে তার জিভ কেটে নেন।

কিংবদন্তি অনুসারে, খনার প্রবল বচনশক্তি রদ করতে তার যে জিভ কেটে নেয়া হয়, তা থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলেই তার মৃত্যু হয়। এই জিভ কেটে নেয়া বা 'খন' করা থেকেই অনাচার্যের এ আশ্চর্যকন্যা লীলাবতীর নাম দেয়া হয়েছে 'খনা'- এমনটাও লোককথায় রয়েছে।

খনার বচন সম্পর্কে রণদীপম বসুর মতে, “এতে আছে কৃষিকাজের বিবিধ রীতি-পদ্ধতি ও নিয়ম-নির্দেশ। হাল, চাষ, বলদ, ভূমি, বীজ, ফলন, বৃষ্টি, বন্যা, শিলা, ঝঞ্ঝা, মাস, ঋতু ও সপ্তাহের বিভিন্ন বার প্রভৃতি সম্বন্ধে জ্যোতিষী ব্যাখ্যা এগুলোর মধ্যে পাওয়া যায়। বৃষ্টি ও আবহাওয়া সম্পর্কে রচিত বচনে সাধারণত বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী থাকে”।

নানা ধরনের ফসল বা শস্য, সেসব চাষের সময়কাল, বীজ বপন, তা ব্যবস্থাপনা, চাষপদ্ধতি, ঋতুভেদে শস্যের ক্ষয়ক্ষতি ও ফলন, পর্যবেক্ষণ করে ফসল উত্তোলন বা কাটার সময় ইত্যাদি কৃষিবিদ্যার নানা রহস্যমোচন হতো খনার বচনে।

শ্রাবণের পুরো ভাদ্রের বারো।

এর মধ্যে যত পারো।।

অর্থাৎ, পুরো শ্রাবণ মাস এবং ভাদ্র মাসের বারো দিন, ধান বা শস্য রোপণ করলে অধিক লাভ পাওয়া যাবে।

ষোলো চাষে মূলা।

তার অর্ধেক তুলা।।

তার অর্ধেক ধান।

বিনা চাষে পান।।

অর্থাৎ, মূলা চাষের জন্য ক্ষেতের মাটি ষোল দিন ধরে চাষ করতে হবে। তুলার চাষের জন্য এর অর্ধেক আট দিন ধরে চাষ করতে হবে। আবার ধানের ফলন বেশি পেতে চার দিন ধরে চাষ করা দরকার। আর পান ফলনের জন্য মাটি চাষের কোনো প্রয়োজনই নেই।

থোর তিরিশে।

বোড়ামুখো তেরো জেনো।।

ফুলোবিশে।

বুঝেসুঝে কাটো ধান্য।।

অর্থাৎ, থোড় জন্মানোর ত্রিশদিন পর তা কাটতে হবে। বা থোড়ের আগা নিচু হওয়ার তেরো দিন পরে কাটলেও হবে। অন্যথায় ক্ষতি হবে।

ভাদ্রের চারি আশ্বিনের চারি।

কলাই রোবে যত পারি।।

অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের শেষ চার দিন আর আশ্বিন মাসের প্রথম চার দিনের মধ্যে কলাই রোপণ করা উত্তম।

সরিষা বুনে কলাই মুগ।

বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক।।

অর্থাৎ, একই জমিতে সরিষা বুনে তাতে কলাই বা মুগ বোনা যাবে। একইসাথে এত ধরনের ফসল পেয়ে চাষী খুশিতে বুক বাজাবে।

পাশাপাশি আবহাওয়া, বর্ষ গণনা, মেঘ-বৃষ্টির শ্রেণিকরণ, ঋতু বদল, গণনা করে আবহাওয়ার আন্দাজ, দুর্যোগ ও প্রকৃতি পরিবর্তনের আগাম প্রস্তুতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুঃসময়ের আগাম বার্তা ইত্যাদি আবহাওয়াশাস্ত্রে বচনগুলোতে আছে গভীর জ্ঞানের ছাপ।

পূর্ণ আষাঢ়ে দক্ষিণা বয়।

সেই বৎসর বন্যা হয়।।

অর্থাৎ, সম্পূর্ণ আষাঢ় মাসে যদি দক্ষিণমূখী বাতাস বয়, তবে সেই বছর বন্যা হয়।

বেঙ ডাকে ঘন ঘন।

শীঘ্র বৃষ্টি হবে জেনো।।

অর্থাৎ, ঘন ঘন ব্যাঙ ডাকলে খুব শীঘ্রই বৃষ্টি হবে।

পৌষে গরমি বৈশাখে জাড়া।

প্রথম আষাঢ়ে ভরবে গাড়া।।

অর্থাৎ, যে বছর পৌষ মাসে শীত কম হয়, বৈশাখ মাসে সে বছর শীত পড়ে। সেই বছরে আষাঢ়ে হবে অতিবৃষ্টি, আবার শ্রাবণে হবে অনাবৃষ্টি।

খনা বলে শুনহ স্বামী।

শ্রাবণ ভাদর নাইকো পানি।।

দিনে জল রাতে তারা।

এই দেখবে দুঃখের ধারা।।

অর্থাৎ, যে বছরে প্রথম বর্ষায় দিনে বৃষ্টি হবে আর রাতে তারা দেখা যাবে মানে বৃষ্টি হবে না, সে বছর অনাবৃষ্টি হবে।

পশ্চিমে ধনু নিত্য খরা।

পূবের ধনু বর্ষে ধারা।।

অর্থাৎ, পশ্চিমদিকে রংধনু দেখা গেলে খরা হবে। আর পূর্ব দিকে রংধনু দেখা গেলে বৃষ্টি হবে।

তারা গণনা, জ্যোতিষশাস্ত্র, শুভ অশুভ বিচার, স্বামী-স্ত্রীর অগ্র-পশ্চাৎ মৃত্যু গণনা, গর্ভের সন্তান পরীক্ষা, জন্মলগ্ন, পরমায়ু গণনা, বিবাহের শুভ-অশুভ ক্ষণ নির্ণয়, নক্ষত্রফল, স্বাস্থ্য ও প্রকৃতির সম্পর্কে খনার ছিল অসাধারণ পাণ্ডিত্য।

অক্ষয় দ্বিগুণ চৌগুণ মাত্রা।

নামে মানে করি সমতা।।

তিন দিরে হরে আন।

তাহে মরা বাঁচা জান।।

এক শূন্যে মরে পতি।।

দুই রহিলে মরে যুবতী।।

এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনি;

দম্পতির মধ্যে কে মরে আগে কে পিছে।

শুনহ জানিতে সাধ যাহার হয়েছে।।

উভয়ের নামের অক্ষর সংখ্যা দুনো।।

চতুগুণ মাথা, নাহি কম হয় জেনো।।

একত্র করিয়া তিন দিয়া আন হরে।

ভাগশেষ এক হলে পতি আগে মরে।।

দুই যদি হয় স্ত্রীর মৃত্যু আগে হয়।

খনার বচন মিথ্যা হইবার নয়।।

পতি সৃষ্টিধর যেন, স্ত্রী কুন্দননন্দিনী।

কে আগে মরিবে তব বল দেখি শুনি।।

অক্ষরের সংখ্যা নয় দ্বিগুণ আঠার।

মাত্রা পাঁচ মোট চতুগুণ বিশ ধর।।

আঠার বিশেতে আটতিরিশ তো হয়।

তিন দিয়া ভাগ কর দুই বাকী রয়।।

অতএব অগ্রে হবে স্ত্রীর মরণ।

অকাট্য জানিবে মনে খনার বচন।

হিসাব সৃষ্টিধর + কুন্দনন্দিনী = নয়টি অক্ষর দ্বিগুণ করিয়া, অ-অ-অ—ই—ঈ—-পাঁচ মাত্রা চতুগুণ করিয়া = মোট /=, ভাগশেষ, অতএব পত্নী অগ্রে মরিবে।

বচনের এতসব জটিল ব্যাখ্যার মাধ্যমে ফুঠে ওঠে খনার আশ্চর্য জ্যোতিষপ্রতিভা।

সকল কিংবদন্তির পাশাপাশি এ মতটাও কখনো শোনা যায়, খনা বলে আদৌ কেউ ছিলেনই না। গ্রামীণ সমাজ সংস্কৃতির প্রচলিত সব ধারণার প্রতিষ্ঠা ও গ্রহণযোগ্যতার চূড়ান্তরূপ দিতে এমন অসাধারণ এক মানবীসত্ত্বা সমাজে তৈরি করা হয়েছে। কিংবদন্তি বা কল্পনা, ইতিহাস বা ইচ্ছা, যেটাই হোক, যুগে যুগে খনা এবং তার বচন হয়ে আছে প্রজ্ঞায় বিদ্যায় অক্ষয়।

ফারিয়া ফাতিমা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic