Loading...
The Financial Express

কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসার আগেই গোয়েন্দা কাজে লাগানোর তোড়জোড়

| Updated: October 19, 2021 17:02:09


কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসার আগেই গোয়েন্দা কাজে লাগানোর তোড়জোড়

গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল দেওয়ার মতো ‘হাস্যকর’ কাজ করছে বিশ্বের অনেক গোয়েন্দা সংস্থা। কথাটা শুনে আপনি অবাক হতেই পারেন। কিন্তু ঘটনার বিশদ বিবরণ দিলে মোটেও আপনার মনে হবে না যে আয়ত্তে না আসতেই আড়ম্বর চলছে। অথবা, কোনো কিছু পাওয়ার আগেই সেটা কীভাবে ভোগে লাগানো যাবে তার তোড়জোড় চলছে। হ্যাঁ, দুনিয়ার খ্যাতিমান অনেক গোয়েন্দা সংস্থাই সংকেতবদ্ধ বার্তা হাতিয়ে নিয়ে নিজের গোপন ভাণ্ডারে জমা করে রাখছে। আগামীতে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কার্যকর পর্যায়ে আসার পর সেসব গোপন বার্তার সংকেতমোচন করা হবে, পাঠ করা সম্ভব হবে। জানা যাবে শত্রুর অনেক অজানা বিষয়। আর এ নিয়ে সতর্ক করছেন যুক্তরাজ্যের সরকারের কাজে যুক্ত এক নিরাপত্তা গবেষক।

ব্রিটিশ সাপ্তাহিক নিউ সায়েন্টিস্টের চলতি সংখ্যায় ম্যাথু স্পার্কস আরো জানান, “হালি হালি গবেষকগোষ্ঠী কার্যকর কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরিতে উদয়াস্ত জান পানি করে খেটে চলেছে। তবে এপর্যন্ত সফল হয়েছে প্রকাশ্য এমন কোনো ঘোষণা আজ অবধি দেয়নি। বার্তাকে সঙ্কেতাক্ষরে লিখতে বা এনকোড করতে এবং সংকেতমোচন বা ডিকোড করতে মৌলিক গুণিতক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এসব বার্তার চাবি শব্দ বা কি ওয়ার্ড জানা না থাকলে প্রচলিত কম্পিউটার দিয়ে পাঠোদ্ধার প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করে এ পর্ব দ্রুতই শেষ করা যাবে। তাতে করে ইমেইল, ব্যাংক খাতের গোপন যোগযোগ এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি ঝুঁকিতে পড়বে।”

অবশ্য অন্যদিকে গবেষকরাও বসে নেই। যদি এরকম পরিস্থিতি সত্যিই দেখা দেয় তাহলে কী করে উপাত্তদের নিরাপত্তা বজায় রাখা যাবে, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। তারা এ লক্ষ্য অর্জনে অ্যালগরিদম তৈরি করছেন। এসব গবেষণা নিয়ে কথা বলেন সাইবার সিকিউরিটি ফার্ম পোস্ট-কোয়ান্টামের অ্যান্ডারসেন চ্যাং। তিনি বলেন, “না, গবেষকরা এমন কাজ শুরু করতে বেশ দেরি করে ফেলেছে।” চ্যাং এর আগে এল৩-টিআরএল নামের একটি কোম্পানিতে কাজ করেছেন। সংকেতায়ন বা এনক্রিপসন প্রযুক্তি যুক্তরাজ্য সরকারকে সরবরাহ করেছে এল৩-টিআরএল। তিনি তার বক্তব্যের যুক্তি তুলে ধরতে যেয়ে জানান, “আগে গোপন উপাত্ত যোগাড় করতে থাকো, পরে পাঠোদ্ধারের কাজ করা যাবে” - নীতির আওতায় কাজ চলছে। গোপন উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার জন্য যোগাযোগ বা কম্পিউটার ব্যবস্থার ওপর হামলা শুরু হয়ে গেছে। এই তৎপরতার আওতায় সংকেতবদ্ধ উপাত্ত যোগাড় করা হচ্ছে। কোয়ান্টাম কম্পিউটার আসা মাত্র যেন দেরি না করেই এসব উপাত্তের সংকেতমোচনের কাজ করা যায় সেজন্য এগুলোকে সুনির্ধারিত পদ্ধতিতে সাজিয়ে রাখার কাজও চলছে।

উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার হামলার কথা তুলে ধরতে যেয়ে চ্যাং আরো জানান, “ইন্টারনেটের যোগাযোগের সময় এমন ঘটনা দেখা যায় যে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ যোগাযোগপথ অস্বাভাবিকভাবে ঘুরে যায়। এটি আবার আপনাআপনি ঠিকও হয়ে যায় এবং কোনো কারণ ছাড়াই এমনটি ঘটে।” এ ধরণের ঘটনা তথ্যউপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার জন্য হামলার বিষয় ইঙ্গিত করে বলেও জানান তিনি। এ ধরণের বিভ্রান্তির কারণে ইউরোপ বা আমেরিকার ইন্টারনেট যোগাযোগ রহস্যজনকভাবে রাশিয়া বা চীনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। কখনো কখনো এই যোগাযোগ ব্যবস্থা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিযোগাযোগ সেবাপ্রদানকারী সংস্থা রোস্তেলিকমের মধ্য দিয়েও যায়।

এমন বিভ্রাট মাঝে মাঝেই দেখা দেয়। এগুলো কোনো কোনো সুনির্দিষ্ট যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে উপাত্ত হাতিয়ে নেওয়ার জন্যও হতে পারে। এ লক্ষ্যে এগুলোর চলার পথ হয়ত উপাত্ত সংরক্ষণকেন্দ্রের মধ্য দিয়ে করে দেওয়া হয়। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবস্থা ইউরোপ এবং আমেরিকার মধ্য দিয়ে গেছে। সেখানেও এমন হামলা হওয়া বিচিত্র নয় বলেই জানান চ্যাং।

তিনি আরো মনে করেন, “এসব ঘটনা ইচ্ছে করেই ঘটানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সম্প্রদায় যদিও এসব উপাত্তের সংকেত মোচন করে আজ পড়তে পারছে না, কিন্তু তারপরও জমা করে রাখছে। ভবিষ্যতে প্রবাদে বর্ণিত কাঁঠাল উপভোগের তেল হয়ে থাকবে এসব উপাত্ত। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এলে তখন আর উপাত্ত যোগাড়ে সময় নষ্ট হবে না।”

কোয়ান্টাম কম্পিউটার কবে থেকে সংকেতায়নের জগতে হুমকি হয়ে দেখা দেবে সে কথা ও সঠিক উত্তর কারো জানা নেই। চ্যাং মনে করেন, প্রকাশ্য যে তৎপরতা চলছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার নিয়ে, গোপন তৎপরতা তার থেকে অনেক এগিয়ে। “কোয়ান্টাম কম্পিউটার কবে আসবে এমন প্রশ্ন সাধারণ মানুষকে করা হলে তারা হয়ত বলবে, ১০ থেকে ২০ বছর লাগবে। কিন্তু একই প্রশ্ন যদি গোয়েন্দা জগতে করা হয়… দেখা যাবে তারা উদ্বেগের মধ্যে আছে এবং বলবে পাঁচ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এসে যাবে।”

২০১৪ সালে এডওয়ার্ড স্নোডেনেরই ফাঁস করা তথ্য থেকে জানা যায়, মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা বা এনএসএ সঙ্কেতমোচনে সক্ষম কোয়ান্টাম কম্পিউটারের পিছে আট কোটি ডলার ব্যয় করেছে। এ কাজে তারা কতোটা এগিয়েছে এবং আজ অবধি এ খাতে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে জানতে হয়তো আরেক স্নোডেনের জন্য দুনিয়াকে অপেক্ষা করতে হবে।

ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল ড্রেসনার জানান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অনেকদিন থেকেই সংকেতবদ্ধ উপাত্ত জমিয়ে রাখছে। পরে সাধারণ কম্পিউটার আসার পর সেসব উপাত্ত পাঠ করতে পেরেছে। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ঘটনাও এসময়ে তুলে ধরেন। পাঠের কোনো ব্যবস্থা বা সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও অনেক আগে থেকেই ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সংকেতবদ্ধ জার্মান বার্তা যোগাড় করেছে। নানাভাবে হাতিয়ে নিয়েছে।

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের দিকে চোখ রেখে এখন এমন তৎপরতা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো চালিয়ে যাচ্ছে – সে কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। তিনি আরো বলেন, “ওরা সবসময়ই এসব কাজ নিয়ে মেতে থাকছে। এর কোনো কোনোটার সংকেতমোচন করা হবে এবং সেগুলো কাজেও লাগবে।”

যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টারের এক মুখপাত্র জানান, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের খপ্পর থেকে নিরাপদ থাকবে এমন অ্যালগরিদমের নকশা তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, “দুই বা তিন দশক পরেও কোনো কোনো স্পর্শকাতর তথ্য শত্রুদের কাছে আকর্ষণীয় হিসেবে গণ্য হবে।” আর এ কথার অর্থ হলো এখনই এ কাজকে অনাগত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের হাত থেকে রক্ষায়  পদক্ষেপ নিতে হবে।

হয়তো এভাবেই ঘোড়া কেনার আগে চাবুক কেনার বা ঘোড়ার দেখা কবে পাবো সে আশায় বসে না থেকে গাড়ি তৈরির কাজে লেগে যেতে হবে। ঘোড়া আসার পর যেন চাবুকের অভাবে সওয়ারির বিলম্ব না হয়। কিংবা গাড়ি জুড়তে যেন সময় নষ্ট না হয়। কাজেই, গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল কে যতই অবাস্তব মনে হোক, অসাধারণ পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে সেরকম অসম্ভব কাজই করতে হয়। এর নামই হলো প্রস্তুতি। বা ‘সদা প্রস্তুত!’

[নিউ সায়েন্টিস্ট অবলম্বনে]

 

 

Share if you like

Filter By Topic