ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। বছরের বিভিন্ন সময়ে এই ঋতু বাংলাদেশের প্রকৃতিকে নতুন রূপে সাজায়। প্রতিটি ঋতুর রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যে,আমাদের পরিধেয় পোশাক নির্বাচনেও কিছু ভিন্নতা থাকা চাই। কেননা, একই ধরনের পোশাক বছরের সব সময় পরা যায় না। শীতে যেমন প্রয়োজন হয় তাপ ধরে রাখার কাপড়, গ্রীষ্মের ক্ষেত্রে তা হয়ে যায় বিপরীত। তাই ঋতুবৈচিত্র্যের দিকে লক্ষ রেখে পরিধেয় পোশাক কেমন হবে- এ নিয়ে আমাদের আজকের লেখা।
গ্রীষ্ম
গ্রীষ্মে বাংলাদেশের তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। সূর্য কর্কটক্রান্তি রেখা বরাবর থাকে। তাই গরম অনেক বেশি অনুভূত হয়। শরীরে ঘনঘন ঘাম হয়। তাই, এ সময়ে সুতি কাপড় পরা বেশি ভালো। সুতি ধরনের, পাতলা ও নরম কাপড় শরীরে তখন কিছুটা হলেও আরাম দেয়। বিশেষ করে, অতিরিক্ত ঘামেন যারা, তাদের জন্য বেশি উপযোগী। সুতি কাপড় ঘাম শোষণ করতে পারে, তাই পরে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া যায়।
এই সময়ে পরিধেয় পোশাকের রঙের দিকেও বিশেষ নজর রাখা দরকার। গাঢ় রঙ যেমন: কালো, গাঢ় নীল- এধরনের রঙ পরিহার করে সাদা, হালকা গোলাপি রঙের পোশাক পরলে ভালো। হালকা রঙের পোশাক সূর্যের আলো শোষণ করে না, প্রতিফলিত করে।
বর্ষা
বর্ষাকালে বাংলা জুড়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। তখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি হওয়ায় শরীরের ঘাম দ্রুত শুকায় না। এই অস্বস্তি দূর করার জন্য বছরের এই সময়ে পাতলা সুতি কাপড় পরাকে অনেকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। ফ্যাশন সচেতন মানুষও তাঁতের বা পাতলা সুতি কাপড়ের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রঙের ক্ষেত্রে, এ সময়ে গ্রীষ্মের মতোই হালকা রঙের কাপড় পরা যেতে পারে। যেহেতু প্রকৃতি তখন গাঢ় সবুজ হয়ে ওঠে, তাই প্রকৃতির সাথে মিল রেখে সবুজ বা হালকা সবুজ রঙের কাপড় বর্ষা কালে পরা যেতে পারে। সাদাও গ্রহণযোগ্য এক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ক্রিকেট খেলার কথা বলতে পারি। টেস্ট ক্রিকেট যেহেতু সারাদিন ধরে চলে, তাই দেখা যায়, এর পোশাকের রঙ সাদা হওয়ায় পরিবেশের সাথে যেকোনো ঋতুতে খুব সহজেই মানিয়ে যায়। এটি পরে খেলতে সুবিধা হয়।
শরৎ
শরৎকালে তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। বাস্তবে খুব বেশি তাপমাত্রার পার্থক্য না হলেও গ্রীষ্মের তুলনায় কম বলা চলে। তাই এ ঋতুতে সুতি, নমনীয় সিল্ক ধরনের কাপড় পরা যেতে পারে। জর্জেট আর শিফন জাতীয় কাপড়ও এ সময়ের সাথে যাবে।
যেহেতু শরতে তাপমাত্রা তুলনামূলক একটু সহনীয় থাকে, তাই সাদা, হালকা নীল, হালকা সবুজ, গোলাপি, হালকা গোলাপি ও সাদার মিশ্রণের মতো বিভিন্ন রঙের কাপড় পরা যেতে পারে।
হেমন্ত
শীতের পূর্বাভাস হেমন্তকাল থেকেই শুরু হয়। এ সময় প্রকৃতিকে ভিন্ন সাজে দেখা যায়। তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমে আসে। বাতাসে আর্দ্রতা ও বাষ্প কম থাকায় শরীরে ঘাম আগের তুলনায় কম হয় হয়। তাই, নিজের ইচ্ছানুযায়ী বিভিন্ন ধরনের কাপড় পরা যায়। কাপড়ের ধরন বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অনেক বিকল্প পাওয়া যায়। হালকা সুতির পরিবর্তে একটু মোটা ধরনের কাপড় পরা যেতে পারে। তাছাড়া আগের কাপড়গুলোও এ ঋতুতে পরে স্বস্তি পাওয়া যাবে।
যেহেতু তাপমাত্রা কমা সত্ত্বেও যথেষ্ট তারতম্য পরিলক্ষিত হয় না, তাই দিনের অবস্থা বুঝে হালকা সুতির থেকে মোটা সুতি বা তাঁত উভয় ধরনের কাপড় পরা যেতে পারে। রঙের ক্ষেত্রে ধূসর, কালো, গাড় বেগুনি, হলুদ, কমলা আরো বিভিন্ন রঙ বাছাই করা যেতে পারে।
শীত
শীতকালে একটানা কয়েকদিন ধরে বয়ে চলে উত্তর দিক থেকে আগত শৈত্যপ্রবাহ। এ বায়ুর জন্য শরীরে উষ্ণতা ধরে রাখা উচিত, পোশাকের ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। এমন ধরনের কাপড় পরলে ভালো হয়, যা শরীরের উষ্ণতা দেহের বাইরে যেতে না দেয়, তাপ ধরে রাখে। এ সময়ে উলের তৈরী কাপড় শরীরের জন্য বেশি উপযোগী। উল দেহের ভেতরের তাপ বাইরে যেতে দেয় না, আর বাইরের কম তাপমাত্রাজনিত তাপ দেহের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয় না। উলের কাপড় ছাড়াও অতিরিক্ত ঠাণ্ডা হলে, চামড়া বা সাসকিন জাতীয় কাপড়ের তৈরী জ্যাকেট আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারবে। তুলার তৈরী কাঁথা, পশমি কাপড়ের কম্বল, মোটা ধরনের কাপড় শৈত্যপ্রবাহে কাঁপুনি রুখে দিতে কার্যকর।
রঙের ক্ষেত্রে অবশ্য এ সময়ে সবাই স্বাধীন। বছরের অন্যান্য সময় বেশি তাপমাত্রার দিকে খেয়াল রেখে পছন্দ না হলেও হালকা রঙের কাপড় পরতে হয়। শীতে যেহেতু এই অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত সমস্যা নেই, তাই যেকোনো রঙই মানানসই।
২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পরিচালক ওয়েস অ্যান্ডারসনের 'দ্য গ্র্যান্ড বুদাপেস্ট হোটেল' এবং ২০০৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্যাথরিন উইকের 'টোয়াইলাইট'- উভয় সিনেমাতেই বরফাচ্ছন্ন দৃশ্যগুলোতে কালো, ধূসর, গাঢ় নীল, রয়্যাল নীল ও গাঢ় লাল উলে, চামড়া বা মোটা ধরনের কাপড় ব্যবহার করা হয়েছে।
বসন্ত
ঋতুরাজ বসন্তে প্রকৃতি শীতের রুক্ষতা ভুলিয়ে দেয় নানান ফুলের মাধ্যমে। প্রকৃতিতে এই সময়ে বিভিন্ন রঙের সমারোহ দেখা যায়। প্রাকৃতিক রঙের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায় বসন্তে। তাই পোশাকেও এর প্রতিফলন আসা স্বাভাবিক।
তাপমাত্রা সহনশীল হওয়ায় সুতি, সুতির মিশ্রণ, লিনেন, আইলেট, সিল্ক জাতীয় কাপড় এই সময়ে পরা যেতে পারে। তবে যেহেতু বাংলাদেশে বসন্তকাল থেকেই গরম দেখা দেয়, তাই সিল্ক, লিনেন, স্যাটিন জাতীয় কাপড় আবহাওয়া বুঝে পরাই শ্রেয়।
এ সময় হলুদ, সবুজ, কমলা, লাল, হালকা নীল বা হালকা নীলের সাথে হলুদ, গোলাপির সাথে হালকা নীল- এ ধরনের রঙের কাপড় বেশ মানিয়ে যাবে। ডেমিয়েন শ্যাজেলের সিনেমা 'লা লা ল্যান্ড'-এ বসন্তকালের পোশাক অনেক রঙিন দেখিয়েছেন। বসন্ত বা গ্রীষ্মের শুরুতে হালকা হলুদ, কমলা বা নীল রঙের পোশাক আরামদায়ক ও সুন্দর। প্রকৃতিকেও যেন নিজের মাঝে এই রঙগুলোর মাধ্যমে সুন্দরভাবে তুলে ধরা যায়।
বছরের বিভিন্ন সময়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন দেখা দেয়। তাই আবহাওয়ার সাথে মিল রেখে পোশাক পরলে চলাচলে অনেক সুবিধা হয়। কর্মব্যস্ত মানুষেরা ঋতু অনুযায়ী কাপড় পরলে স্বস্তি অনুভব করবেন।
মোঃ ইমরান খান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত।