গায়ে আগুন দিয়ে ঠিকাদার গাজী আনিসের আত্মহত্যার ঘটনায় হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার নুরুল আমিন ও তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে আনিসের বড় ভাই নজরুল ইসলাম শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন বলে জানান ওই থানার এসআই গোলাম হোসেন খান।
তিনি বলেন, “মামলায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।”
৫০ বছর বয়সী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ায়, তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। এক সময় কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। স্থানীয়রা তাকে চেনেন গাজী আনিস নামে। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার বিকালে প্রেস ক্লাবের ফটকের ভেতরে খোলা স্থানে আনিস নিজের গায়ে আগুন দেন। শোয়া অবস্থায় তার গায়ে আগুন জ্বলছে দেখে আশপাশ থেকে সবাই ছুটে যান। তারা পানি ঢেলে আগুন নেভান। তবে ততক্ষণে তার গায়ের পোশাক সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।
পরে তাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার ভোর ৬টা ১০ মিনিটে তার মৃত্যু হয় বলে ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন জানান।
আনিসকে বার্ন ইনস্টিটিউটে নেওয়ার সময় ছিলেন মো. আলী নামে এক সংবাদকর্মী। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তিনি বলেছিলেন, “তার সঙ্গে একটু কথা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, একটি কোম্পানির কাছ থেকে তিনি ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা পাবেন। ওই কোম্পানি তা দিচ্ছে না। পাওনা পেতে তিনি এর আগে মানববন্ধন করেছিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তাই তিনি নিজের গায়ে আগুন দেন।”
মামলায় নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ২০১৬ সালে হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা হয় তার ভাই ‘আনিসুরের’। তারা একসঙ্গে বিদেশ ভ্রমণও করেন। তাদের মধ্যে ‘খুবই সখ্য’ গড়ে উঠে। ২০১৮ সালে তারা (নুরুল দম্পতি) হেনোলাক্স কোম্পানিতে ‘লভ্যাংশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে’ বিনিয়োগ করার জন্য আনিসুর রহমানকে অনুরোধ করেন।
“তাদের অনুরোধে বিশ্বাসের ভিত্তিতে প্রথমে এক কোটি এবং পরে তার বন্ধুর কাছ থেকে আরও ২৬ লাখ টাকা নিয়ে আনিসুর হেনোলাক্সে বিনিয়োগ করেন।”
গাজী আনিস।গাজী আনিস।এ বিনিয়োগের প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদন করা হলেও হেনোলাক্সের পক্ষ থেকে ওই দুইজন চূড়ান্ত চুক্তি সম্পাদন করতে ‘গড়িমসি করেন’ অভিযোগ করে এজাহারে বলা হয়, “এরই মধ্যে কিছুদিন আমার ভাইকে লভ্যাংশ দিলেও পরে তা বন্ধ করে দেয় এবং চূড়ান্ত চুক্তি করতে গড়িমস করে।“
পরে এ বিষয়ে কথা বলতে গেলে আমিন বিভিন্ন লোক দিয়ে ‘নানাভাবে হেনস্তা এবং ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন’ বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।
লভ্যাংশসহ এখন পর্যন্ত তিন কোটি টাকা পাওনা রয়েছে দাবি করে এজাহারে বলা হয়, ওই টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করেও না পেয়ে কুষ্টিয়ায় হেনোলাক্সের দুইজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন আনিসুর।
এজাহারে নজরুল ইসলাম বলেছেন, গত ৪ জুলাই বেলা ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে আনিসুর রহমান তাকে ফোন করে জানান, ওই দিন বিকালে পাওনা টাকার চেক হেনোলাক্সের কর্ণধার ডা. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিন দেবেন বলে তাকে জানিয়েছেন। কিন্তু বিকালে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা কোনো চেক দেননি।
এর পরপরই প্রেস ক্লাবে এসে আনিস গায়ে দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেন এবং পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে মঙ্গলবার সকালে তার মৃত্যু হয় জানিয়ে এজাহারে বলা হয়, ‘প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চেক না দিয়ে এবং বিরূপ আচরণ করে’ আনিসুর রহমানকে আত্মহত্যা করতে ‘প্ররোচিত করা হয়েছে’।
নজরুল ইসলাম বলেন, তার ভাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
“কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন আওয়ামী লীগের দুঃসময়। সে সময় সংগঠনের পিছনে তার অবদান অনেক। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরেও তিনি কখনও কোথাও তার সেই পরিচয় ব্যবহার করতে না, প্রভাব খাটাতেন না।
“তিনি আমার কাছেও বেশি কিছু বলতেন না। খুবই শান্ত স্বভাবের ছিলেন এবং নিজেই চেষ্টা করতেন সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য।”
গত ২৯ মে ঢাকায় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে হেনোলাক্স গ্রুপে সোয়া কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ‘প্রতারিত’ হওয়ার অভিযোগ করেছিলেন আনিস।
তার দুদিন পর ৩১ মে এক ফেইসবুক পোস্টে তিনি হেনোলাক্স গ্রুপের মালিকের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূত্রপাত এবং বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়ার অভিযোগগুলো তুলে ধরেন।
আনিস সেখানে লেখেন, “২০১৮ সালে কলকাতা হোটেল বালাজীতে একসঙ্গে অবস্থানকালে উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এককোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ছাব্বিশ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসেবে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)।
“বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি, তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি, কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন।”
এসব অভিযোগের ব্যাপারে নুরুল আমিন বা তার কোম্পানির কারও বক্তব্য জানতে পারেনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।