রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত বেশির ভাগ নারী চরিত্র তরুণী, বিশেষত কিশোর বয়সী। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরল এবং চঞ্চল স্বভাবের, যেন বাকি দুনিয়ার পরোয়াই করে না তারা। রবি ঠাকুরের মতে, নারীর একটি দ্বৈত সত্তা রয়েছে। একজন মা এবং একজন প্রেয়সী।
‘সমাপ্তি’র মৃন্ময়ীকে ভোলা যায় না, কারণ তার মতো চরিত্র সব সময়েই একজন পাঠকের মনে ছাপ রেখে যায়। কিন্তু প্রত্যেকেই তো আর তার মতো হয় না, বা হতেও পারে না যেহেতু নারীকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যেহেতু কিছুটা অবদমিত, লাজুক এবং অন্তর্মুখী হতে হয়। সে সময়ে তো তা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং বাধ্যগত স্বভাব।
এসব ছাঁচে-ঢালা নারীদের মাঝে, মৃন্ময়ীকে মনে রাখা যায় তার অবাধ্যতার জন্যই। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, শেষটায় সে-ও ভালোবাসার জন্য আত্মসমর্পণ করে। নারীর সর্বতো বলিদানের চেহারাটা রবি ঠাকুরের লেখনীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। তা সে হৈমন্তীই হোক, নিরুপমা কিংবা মৃণাল। এদের তিনজনকেই শ্বশুরবাড়িতে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হয় এবং শেষমেশ তারা সকলেই একটা সময় হাল ছেড়ে দেয়। কুমুদিনী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র। সে হাল ছেড়ে না দিয়ে প্রতিবাদ করে ঠিকই, কিন্তু তা ক্ষণস্থায়ী। কল্পকাহিনীর সুখকর সমাপ্তির জন্য সে-ও দিন শেষে স্বামীর কাছেই ফিরে যায় সমঝোতার ফরমানে।
তবে এসব কিছুর পরও এই নারী চরিত্রগুলোর প্রকাশে বহু বিচিত্রতা রয়েছে এবং খুব সহজে ছাঁচে ফেলা বা শ্রেণিভুক্ত করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনী পাঠকদের সব সময়ই তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মাথার ভেতর এক অদ্ভুত যাত্রায় নিয়ে যান। তাদের এমন সব স্বপ্ন পাঠক জানতে পারে, যা তারা কাউকে কোনো দিন বলতে পারেনি।
নিয়মিত বলিদানের হাসির পেছনে লুকিয়ে থাকা বেদনা, বারবার ভেঙে যাওয়া একই স্বপ্ন কিংবা তাদের নিত্যদিনের লড়াই কেউ অনুভব করতে পারে না। কিন্তু পাঠকের দৃষ্টিতে, আমরা পারি।
রবি ঠাকুর সেই সব দমে যাওয়া নারী চরিত্রদের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটিয়েছেন, যারা তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ও জীবনযাপনের ধরনে একটি নির্দিষ্ট গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারত না। তবে এরও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে।
‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য, ‘চোখের বালি’র বিনোদিনী বা ‘রক্তকরবী’র নন্দিনীরা এমন গণ্ডিবদ্ধ ছিল না। তাদের ব্যক্তিত্বের আলোকছটা তাদের সময় ও পরিপার্শ্বকে অতিক্রম করে গেছে আলোরই গতিতে। আর এ কারণেই তাদের আমরা বিপরীতে রাখতে পারি অন্যান্য নারী চরিত্র থেকে। তাদের সবার নিজস্ব অবস্থান রয়েছে, আছে জীবন থেকে নেওয়া নিজস্ব কিছু শিক্ষাও। তবে আমরা এও দেখতে পাই, ব্যতিক্রম হওয়ার জন্য তাদের চড়া মূল্য চোকাতে হয়। ঠিক যেমন কলঙ্কিত হতে হয়েছিল ‘নটী বিনোদিনী’কে,যিনি ঊনবিংশ শতকের সেই মঞ্চ অভিনেত্রী যার নামে ‘বিনোদিনী’ চরিত্রের নামকরণ।
লাবণ্য একজন শিক্ষিতা এবং আধুনিকা নারী, যার বুদ্ধিদীপ্ত মনন রয়েছে। তবু সে তার সত্যিকারের প্রেমিকের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারেনি। এমনকি সে সেই প্রেমের সঙ্গে থাকতে পারেনি, যে তাকে মুক্তি দিয়েছিল। তার বদলে সে বেছে নেয় এমন একজনকে, যে কিনা বহু আগে থেকেই তাকে মন সঁপেছিল।
নন্দিনী সব সময়েই সবার থেকে আলাদা। সে তার নিজের জগতেই থাকে। সে অপেক্ষা করে, চারপাশের অন্ধকার ভেদ করে একদিন আলোর পশলা আসবে। অভিশপ্ত সময়ে নন্দিনীকে প্রকাশ করা হয়েছে আশা এবং আনন্দের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু রবি ঠাকুরের অন্য রচনার মতো, এখানেও নন্দিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হয়তো স্বপ্ন দেখার মূল্য চোকাতে হয় তাকেও।
এই স্বাধীন নারী চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব আমাদের দেখায়, দিন শেষে একজন মুক্ত নারী ব্যর্থ হবেই। এমন নয় যে পরাধীনরা ব্যর্থতার মুখ দেখে না, তারাও বেশির ভাগ সময় পরাজিতই হয়। তবে তারা অন্তত সমাজের কাছ থেকে সমবেদনা পেয়ে থাকে, যা কিনা তাদের একমাত্র পুরস্কার।
বিষয়টি ভাবনার খোরাক জোগায় যে রবি ঠাকুর একজন লেখক হিসেবে তাঁর সৃষ্ট বেশির ভাগ নারী চরিত্রের জন্যই দুঃখময় সমাপ্তি বেছে নিয়েছেন। শুরুতে তারা যতটাই বাঁধভাঙা হোক না কেন শেষমেশ আত্মসমর্পণের পথেই সেই নারীরা এগিয়ে যায়।
লেখক অনিন্দিতা চৌধুরী বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন। ইমেইল[email protected]