Loading...

হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ খেলাধুলা

| Updated: March 03, 2021 10:07:10


ছবি: এফই ছবি: এফই

ব্যস্ত এই জীবনে শেষ কবে ফিরে গিয়েছিলেন শৈশবের স্মৃতিতে?

নগর সভ্যতার যান্ত্রিক এ জীবনে হঠাৎই মনে পড়া ছেলেবেলার কোনো স্মৃতি এনে দিতে পারে শান্তির কিছু মুহূর্ত। শৈশব মানেই স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। মানুষ বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়ে বেড়ায় সাগরসম শৈশবস্মৃতি। আর সে স্মৃতির অনেকটা জুড়েই থাকে দুরন্তপনা, বন্ধু আর বিচিত্র সব খেলাধুলা।

আধুনিক যুগে খেলার অংশ হিসেবে শিশু-কিশোরের হাতে উঠে আসছে বিভিন্ন ডিভাইস, নানা ধরনের ভিডিও বা মোবাইল গেম। সেই সঙ্গে চলছে নগরায়ন; কমে যাচ্ছে খেলার মাঠ, পার্ক, বিল-ঝিল।

ঘরের বাইরে খেলার সময় ও সুযোগ নেই বললেই চলে। এমনকি অনেকটাই বদলে গিয়েছে চিরচেনা গ্রামের দৃশ্য। ডিজিটাল যুগের আওতায় গ্রামে এখন 'মোবাইল গেম' এর রীতিমতো টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে দেখা যায়।

আধুনিকতা এবং কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এবং হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ খেলাধুলা; যা একসময় বহন করত আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য। আজকের এ লেখায় কথা হবে এমনই কয়েকটি খেলা নিয়ে।

কাবাডি বা হা-ডু-ডু

হা-ডু-ডু ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা। এ খেলায় দুটি দল প্রতিযোগিতা করে। প্রতি দলে আট-দশজন করে খেলোয়াড় অংশ নেয়। কোর্টের আকার দৈর্ঘ্যে সাড়ে ১২ মিটার এবং প্রস্থে ১০ মিটার হয়ে থাকে। এ খেলায় একজন খেলোয়াড় লম্বা দম নিয়ে প্রতিপক্ষকে ছুঁয়ে বেরিয়ে আসে। প্রতি দলের কোনো খেলোয়াড় একের পর এক ‘কাবাডি কাবাডি’বলে প্রতিপক্ষের দলে প্রবেশ করে প্রতিপক্ষের কাউকে স্পর্শ করলে, দল পয়েন্ট পায় এবং যে প্রতিপক্ষ দলের যে খেলোয়াড়কে ছোঁয়া হয়, সে বাদ যায়।

অন্যদিকে, যদি প্রতিদ্বন্দ্বী দলে প্রবেশ করে দলকে ছুঁতে গিয়ে ধরা পড়ে, দম রাখতে রাখতে সে তার সীমানায় ফিরে আসতে না পারে, তবে খেলোয়াড়টি খেলা থেকে বাদ পড়ে যায়। জয় বা পরাজয় নির্ভর করে – একদিকে কতজন লোক অন্যকে স্পর্শ করে বা ধরে বাদ দিতে পারে তার ওপর। হা-ডু-ডু বা কাবাডি কেবল আমাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী খেলা নয়, পুরো উপমহাদেশেও একটি জনপ্রিয় খেলা। এটি কাবাডি নামে সাফ গেমসেও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

 

গোল্লাছুট

বাংলাদেশের আরেকটি জনপ্রিয় খেলা গোল্লাছুট। কেবল শিশু-কিশোর নয়, এতে অনেক সময় অংশ নেয় বড়রাও। ‘গোল্লাছুট’, নাম শুনেই বোঝা যায়, খেলাটি 'গোল্লা' বা বৃত্ত এবং 'ছুট' বা দৌড়ানোর সঙ্গে সম্পৃক্ত।

এ খেলায় দু’টি দল থাকে। প্রতি দলে একজন করে দল নেতা নির্বাচন করা হয়। প্রতি দলে সমান সংখ্যক (পাঁচ বা সাতজন) খেলোয়াড় থাকে। খেলা শুরুর আগে মাটিতে এক জায়গায় গর্ত করে কাঠি পুঁতে রাখা হয়। এর চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করা হয় এবং ২৫/৩০ ফুট দূরত্বে একটি রেখা এঁকে সীমানা ধরা হয়। দলপতি বা পালের গোদা এক হাতে মাটিতে খননকৃত কাঠি ধরে এবং দলের অন্য খেলোয়াড়দের অপর হাতে ধরে রাখে।

এভাবে, তারা একে অপরের হাত ধরে কেন্দ্র স্পর্শ করে ঘুরতে থাকে। লক্ষ্য থাকে বৃত্তের বাইরের যে কাঠি বা গাছ থাকে, (দ্বিতীয় লক্ষ্য) তা দৌড়ে স্পর্শ করা। বৃত্ত বা গোল্লা তৈরি করে ঘুরতে হয় বলে এবং দৌড়াতে হয় বলেই খেলার নাম গোল্লাছুট।

খেলোয়াড়রা কাঠিটি স্পর্শ করার আগেই বিপক্ষ দলের কোনো খেলোয়াড় তাদের কাউকে ছুঁয়ে দিলে সে এ খেলা থেকে বাদ পড়বে। শেষ অবধি কোনো খেলোয়াড়ই যদি লক্ষ্যে না পৌঁছাতে পারে, বিপক্ষ দল পয়েন্ট পায়।

 

এক্কা দোক্কা

ধান শুকানোর ফাঁকে বা বাড়ির আঙিনায়, নরম মাটিতে দাগ কেটে মেয়েদের এক্কা-দোক্কা খেলা গ্রামের খুবই পরিচিত এক দৃশ্য। মাটির তৈজসপত্রের ভাঙা অংশ বা স্থানীয় নাম 'চাড়া' বা 'ঘুঁটি' দিয়ে মাটিতে আয়তাকার দাগ কেটে, দাগের মধ্যে আরও ছয়টি দাগ কেটে এটি খেলা হয়।

একা একা খেলা গেলেও বেশ নিয়ম-কানুনসহ বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এক্কা-দোক্কা খেলতেই বেশি দেখা যায়। প্রতি ঘরে ঘুঁটি ফেলে, ঘুঁটিসমেত এক পায়ে লাফ দিয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। আঙুলের টোকায় ঘুঁটি বা পা দাগের ওপর পড়লে খেলোয়াড় দান হারায় এবং দ্বিতীয়জন দান পায়। অঞ্চলভেদে এক্কা-দোক্কা খেলার নিয়মাবলীতে বৈচিত্র্যও দেখা যায়।

 

ডাংগুলি

বাংলাদেশের সর্বত্র জনপ্রিয় এই খেলা সাধারণত ছেলেরাই খেলে। একে বলা হয় ক্রিকেটের গ্রাম্য সংস্করণ। এ খেলায় উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তিন-চার ইঞ্চি লম্বা, দুই প্রান্ত সুচালো একটি শক্ত কাঠি, যা গুলি নামে পরিচিত। থাকে দেড় হাত লম্বা একটি লাঠি, যা ডাণ্ডা নামে পরিচিত। ডাণ্ডা দিয়ে গুলি মারার এ খেলা বেশ প্রতিযোগিতামূলক এবং মজাদার। তবে গুলির সুচালো প্রান্ত ও তীব্র বেগের জন্য খেলাটি প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

 

পুতুল খেলা

ছেলেবেলার সবচেয়ে পরিচিত খেলাগুলোর মধ্যে একটি হলো পুতুল খেলা। মানবদেহের আকৃতিতে মাটি, কাঠ বা কাপড় দিয়ে রং-বেরঙের পুতুল বানিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে, মেলায়, হাটে বৈচিত্র্যময় সাজের নানা ধরনের পুতুল কিনতেও পাওয়া যায়।

অভিনয় করে করে সেসব পুতুলকে অনেক যত্নে খাওয়ানো, গোসল করানো, কাপড় পরানো, ঘুম পাড়ানো হয়। এমনকি শিশুরা পুতুলকে আদরের সঙ্গে সঙ্গে তা প্রতি কপট রাগ-অভিমানও করে। ঘটা করে পুতুল সাজিয়ে, অনেক সময় চড়ুইভাতি এবং ছড়া গান করে, একজনের মেয়ে পুতুলের সঙ্গে আরেকজনের ছেলে পুতুলের বিয়ে দেওয়া হয়। পুতুল খেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো এই পুতুলের বিয়ে।

 

ওপেনটি বায়োস্কোপ

 

‘ওপেন টি বায়োস্কোপ

নাইন টেন তেইশ কোপ

সুলতানা বিবিয়ানা

সাহেব বাবুর বৈঠকখানা

সাহেব বলেছে যেতে

পান সুপারি খেতে

পানের আগায় মরিচ বাটা

ইস্পিরিংয়ের চাবি আঁটা

যার নাম রেনুবালা

তাকে দেবো মুক্তার মালা।’

 

দল গঠনে সহায়ক খেলাটির এই ছড়া গানটি মূলত ব্রিটিশ যুগের ইংরেজ সাহেবদের বিনোদনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে তৈরি। তবে নিছক বিনোদন হিসেবেই গ্রামীণ জনপদে, বিশেষত মেয়েদের মধ্যে খেলাটি জনপ্রিয়। মুখোমুখি অল্প দূরত্বে দু’জন খেলোয়াড় দাঁড়িয়ে পরস্পরের হাত দুটো উঁচু করে ধরে রাখে। তোরণসদৃশ হাতের নিচ দিয়ে খেলায় অংশগ্রহণকারী বাকিরা পরস্পরের কাঁধে হাত রেখে রেলগাড়ির মতো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছড়া বলতে বলতে চক্রাকারে যাতায়াত করতে থাকে।

ছড়া শেষ হওয়ার মুহূর্তে যে খেলোয়াড় তোরণের মাঝামাঝি থাকে, তোরণসদৃশ দুই খেলোয়াড় হাত নামিয়ে তাকে বন্দী করে ফেলে। তারপর মূল খেলা শুরু হয়, বা অনেক সময় এটিই মূল খেলা হয়ে থাকে।

এসবের বাইরেও আছে বহু খেলা। টাই টোকা, বরফ-পানি, মাংস চোর, হাঁড়িভাঙা, দড়িলাফ, বোমবাস্টিং, দড়ি টানাটানি, এলাটিং বেলাটিং, চিক্কা, ছি-ছা, কপাল টোকা, লাটিম, আগডুম বাগডুম, ইকড়ি-মিকড়ি, বউরানি, সাত পাতা, চরক গাছ, ছক্কা, কুমির কুমির, লাঠিখেলা, বলীখেলা, রস-কষ, চোর ডাকাত, মার্বেল, সাতচাড়া, ষোলগুটি, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, ইচিং বিচিং, এক্কাদোক্কা, ওপেন টু বায়োস্কোপ, কড়ি খেলা এখন আর কোথাও তেমন চোখে পড়ে না। ডুব সাঁতার, বাটল, বাঁশের বন্দুক, তীর ধনুক খেলার মতো দুরন্তপনার দিনগুলো নতুন প্রজন্মের কাছে কেবলই গল্প।

এই গ্রামীণ খেলাগুলো আমাদের আদি গ্রামীণ সংস্কৃতির অংশ, যা বিলুপ্ত হতে হতে এখন আর অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কিন্তু স্মৃতির পাতা হাতড়ালে মনে হবে, এইতো সেদিন যেন এসবে কেটেছে দুরন্ত শৈশব-কৈশোর।

 

ফারিয়া ফাতিমা স্নেহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করছেন।

Share if you like

Filter By Topic