Loading...

স্বাদহীন স্বাধীনতা: দক্ষিণ সুদানের ‘নষ্ট’ দশক

বয়সের হিসাবে দুনিয়ার সবচেয়ে কনিষ্ঠ রাষ্ট্রটি স্বাধীনতার গোটা একটি দশক পার করেও রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত, হাঙ্গামা, সহিংসতা, তেল উৎপাদন পড়ে যাওয়া এবং দুর্ভিক্ষের অশনি সংকেতের মধ্যে দিন-যাপন করছে!


| Updated: September 17, 2021 17:16:34


সদ্য স্বাধীন হওয়া দক্ষিণ সুদানের পতাকা হাতে ২০১১ সালে সেদেশের এক শিশু সদ্য স্বাধীন হওয়া দক্ষিণ সুদানের পতাকা হাতে ২০১১ সালে সেদেশের এক শিশু

এক দশক আগে সুদান ভেঙে স্বাধীনতা অর্জন করেছে দক্ষিণ সুদান। তারপর পরিবারের অনেককেই হারিয়েছে নতুন দেশটির ৫২ বছর বয়সী রোজা জাম্বা। নিহতদের সংখ্যা গুণতে ভুলেই গেছেন এই অভাগী ভুট্টাচাষী। দাঙ্গা থেকে জান বাঁচাতে দক্ষিণের রাজ্য সেন্ট্রাল ইকুএটোরিয়ার নিজ গ্রাম ছেড়ে ভাগতে হয় জাম্বাকে। নিজ বাড়ি থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ইয়েতে অস্থায়ী এক শিবিরই হয়েছে এখন তার ঠাঁই।

লড়াই” ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য করেছে। আস্তে আস্তে এ কথা বলেন রোজা। দুনিয়ার সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী, দক্ষিণ সুদানের পিপল’স ডিফেন্স ফোর্সেস সঙ্গে ন্যাশনাল স্যালভেশন ফন্ট্রের অনুগত বিদ্রোহীদের লড়াইয়ের কথাই বলেন তিনি। সেনাবাহিনীর প্রাক্তন জেনারেল থমাস সিরিলো এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চার বছর আগে দক্ষিণ সুদানের সেনাবাহিনী ত্যাগ করেন তিনি। ইকুএটোরিয়ান বিদ্রোহের ঘোষণা দেন।

রোজা বলেন, “দুপক্ষই গুলি ছুঁড়ছিল। যুদ্ধ করে তারপর লুটপাটও করছে।” কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সেন্ট্রাল ইকুএটোরিয়ার লড়াইয়ে সাত হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। ইয়েতে তারা  আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। রোজা ভগ্ন স্বরে বলেন, “লড়াই, লুটপাট, ধর্ষণ – সেই কিশোর বয়স থেকেই এ সব দেখেছি বহুবার। আমিও মোটেও সুখ পাইনি, সুখী নই। খাওয়া-দাওয়া যদি না থাকে, আমরা যদি গরিবই থাকি এবং শান্তিতে থাকতে না পারি, তবে দেশের স্বাধীনতার মানে দাঁড়ালো কি?”

গোটা দক্ষিণ সুদান জুড়েই রোজার কথার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যাবে। গত জুলাইয়ে দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার এক দশক পূর্তি হলো। কিন্তু দেশটিতে বিরাজমান অশান্তি দূর করতে কোনো রাজনৈতিক চুক্তি হবে – না, এমন কোনো আশার সামান্য আলোকচ্ছটাও এখনো দেশটির দশদিগন্তের কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দেশটিতে ২০২৩ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘাত চলছেই। কোনো নীতিই বাস্তবায়ন হচ্ছে না। নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে এমন আশার গুড়েও বালি পড়ছে প্রতিদিন।

আফ্রিকার মানচিত্রে সুদান ও দক্ষিণ সুদান

সুদান ভেঙ্গে ২০১১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে দক্ষিণ সুদান। তার মাত্র দুবছর পরেই দেশটির প্রেসিডেন্ট সালভা কির এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট রিয়েক মাচারের প্রতি অনুগত বাহিনীগুলো দ্রুত লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। নির্মম এ সহিংসতায় প্রায় চার লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। আর নবজাতক দেশটি গড়ে তোলার সব তৎপরতা গুম হয়ে যায়। নতুন দেশকে নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে নেমে যায় সেখানকার জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো। প্রত্যেক গোষ্ঠীই নিজেদের প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা আঁকড়ে এ লড়াইয়ে নামে। দক্ষিণ সুদানের বৃহত্তর জাতিগত গোষ্ঠী নুয়েরের সদস্য মাচার এবং অন্যতম জনবহুল গোষ্ঠী দিনকার সদস্য কির। এরা দুজনেই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। রক্তপাত এবং হিংসা-বিদ্বেষের এ ধারায় আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে মারাত্মক শরণার্থী সংকটের জন্ম হয় দেশটিতে। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর অসহায় শরণার্থীর এমন ঢল আর দেখেনি এ মহাদেশ। জ্বালানি তেল থেকে পশু-চারণ ভূমির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে প্রতাপশালী গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই দেশটিতে গত এক দশক ধরে যুদ্ধ-বিগ্রহকে উস্কে দিচ্ছে এবং জিইয়ে রেখেছে বলে ধারণা স্থানীয় পর্যায়ের বিশ্লেষকদের। আর এর মূল্য দিচ্ছে দেশটির এক কোটি ২০ লাখ অসহায় আদম সন্তান। এ সব মানুষের দুই-তৃতীয়াংশই এখন মানবিক ত্রাণের প্রয়োজনের ধুঁকছে। হিসাবটি দিয়েছে জাতিসংঘ।

সাউথ সুদান কাউন্সিল অব চার্চেস দেশটির জন্য গত দশ বছরকে “একটি অপচয় হওয়া দশক” হিসেবে উল্লেখ করেছে। কিরের মাথায় সব সময় শোভা পায় কাউবয় হ্যাট। তিনিও দক্ষিণ সুদানবাসীদের কাছে এক আবেদনে বলেন, “ হারানো এক দশককে উদ্ধার করতে হবে।” দক্ষিণ সুদানে জাতিসংঘ প্রতিনিধি নিকোলাস হেসাম গত মাসে বলেন, “নজিরবিহীন মাত্রায়” চলছে অন্তঃকলহ। এ রকম কলহ ও যুদ্ধ-বিগ্রহের জেরে ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে রোজার মতো আরো অনেকেই ।

সেন্ট্রাল ইকুএটোরিয়ার ইপিসকোপাল(খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ ইপিসকোপাল। এই মতবাদের অনুসারীরা পোপের কর্তৃত্ব মান্য করেন না। এই মতাবলম্বী খ্রিস্টান পুরোহিতরা বিবাহ করতে পারেন)  আর্চবিশপ পল ইউগুসুক স্বীকার করেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে “নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে। তিনি আরো বলেন, “এতে অনেক গণহত্যা ঘটছে। আমাদের মানুষগুলো নিহত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে এবং বাস্তুহারাও হচ্ছে...দেশ হিসেবে আমরা যাচ্ছেতাই ভাবে যাত্রা শুরু করেছি।”

২০১৩ এবং ২০১৬ সালের গৃহযুদ্ধের পর্বগুলো এক চুক্তি সইয়ের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালে সমাপ্ত হয়। তবে এখনো এ চুক্তি পুরো বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। বিবাদের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ২০২০ সালে কিরের সহযোগী হিসেবে নতুন ঐক্য সরকারে যোগ দেন মাচার। ২০০৫ সালে সুদানের পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট/ আর্মি ( এসপিএম/এ)র দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং ২০১০ সালে দক্ষিণ সুদানের স্বায়ত্তশাসিত  অঞ্চলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়ে নিজকে খ্যাতিমান করে তোলেন কির।

কির এবং মাচারের "পুনরুজ্জীবিত" ঐক্য সরকার দলবাজি ও গোষ্ঠীবাজির চোরাবালিতে ধরা খেতে থাকে। আগস্টে মাচারের অনুগতদের সঙ্গে সংঘাতে নামে তাঁকে উৎখাতের চেষ্টায় লিপ্ত সুদান পিপলস লিবারেশন মুভমেন্ট-ইন-অপজিশন নামের দলছুট অংশ।

এরপরও মাচারের সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাঞ্জেলিনা টেনি বলেন, “বিশাল একটি সুন্দর দেশের বড় ধরণের স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন দেখেছি সমৃদ্ধ একটি দেশের। আর স্বাধীনতার ১০ বছর বাদে আমরা সুখী যে এমন দেশ আমরা পেয়েছে। এটাই আমাদের বিরাট অর্জন। আমাদের কোনো দুঃখবোধ নেই। এ দেশ কেউ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তবে স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের খুবই মুশকিলের সময় যাচ্ছে। ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়াতেই এ সব মুশকিলের সূচনা।”

[ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে বাংলা রূপান্তর সৈয়দ মূসা রেজা]

Share if you like

Filter By Topic