Loading...

নেকাব খুলছে উসমানিয়দের সোনালী অতীত

| Updated: December 08, 2021 17:56:57


- পিরি রেইসের মানচিত্র - পিরি রেইসের মানচিত্র

গ্যালিপোলির পিরি রেইসের মূল মানচিত্র দেখার সৌভাগ্য অনেকেরই হয়নি। তুরস্কের সমৃদ্ধ ঐতিহাসিক সম্পদের অন্যতম এই মানচিত্র ঘটনাক্রমে দেখতে পেয়েছিলেন লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক ইতিহাসের অধ্যাপক মার্ক ডেভিড বেয়ার। ভাগ্য হেসে না উঠলে এটি স্বাভাবিক ভাবে অধ্যাপকের দেখতে পাওয়ার কথা ছিল না।

তুর্কি নগরী ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক প্রাসাদ তোপকাপির মহাফেজখানায় সংরক্ষিত রয়েছে মানচিত্রটি। এখানেই গবেষণা করেছেন বেয়ার। তাঁর সে গবেষণার ফসল হলো সাড়া জাগান বই, ‘দ্যা অটোম্যানস: খানস, সিজারস অ্যান্ড খলিফস।’এ বছরের অক্টোবর মাসে বেসিক বুকস প্রকাশ করেছে বইটি।

দ্য অটোম্যানস বইয়ের প্রচ্ছদ

তোপকাপিতে নিজ কাজের মনমাতানো বিবরণের মাধ্যমে সূচনা হয়েছে তাঁর বইয়ের। মহাফেজখানা গবেষকবান্ধব নয়। সেখানে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গবেষণা করাও নয় মোটেও আরামদায়ক।

তুরস্কের খ্যাতিমান নৌসেনাপতি কিলিক আলি পাশার পূর্বসূরি পিরি রেইস। গ্যালিপোলির অধিবাসী সাবেক জলদস্যু রেইসের আঁকা মানচিত্রে ‘নতুন দুনিয়া’(নামে পরিচিত আমেরিকার) উপকূলকে দেখানো হয়েছে। ‘নতুন দুনিয়ার’ যে সব মানচিত্র টিকে আছে তার মধ্যে এটিই  সবচেয়ে পুরানো। বেয়ার লিখেছেন, “কলম্বাসের আসল মানচিত্রের ভিত্তিতে তৈরি  হয়েছিল এটি। অবশ্য, কলম্বাসের সে মানচিত্র হারিয়ে গেছে। সুলতানের জন্য  পিরি তৈরি করেন নতুন এই মানচিত্র। মানচিত্রটি খুঁতহীন করে আঁকার জন্য কলম্বাসের সাগর অভিযানের এক নাবিকের সাক্ষাৎকার নেন পিরি রেইস। এ ছাড়া, প্রাচীন টলেমিয়, মধ্যযুগের আরবিয়, এবং সমসাময়িক পর্তুগিজ এবং স্পেনিয় মানচিত্রের সহায়তা নিতে কার্পণ্য করেননি তিনি।” (ইউরোপের দক্ষিণপশ্চিম প্রান্তের) আইবিরিয়া উপদ্বীপ থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পর্তুগিজদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার লক্ষ্য তাঁর সামনে ছিল। এ লক্ষ্যেই ইউরোপের আবিষ্কারগুলোর সঙ্গে তাল রেখে চলার চেষ্টায় তৎপর ছিল উসমানিয়রা।

উসমানিয় অন্যান্য নৌ-সেনাপতিরাও জ্যোতির্বিদ্যা এবং নৌ বিজ্ঞান বা নটিক্যাল সায়েন্সের উপর বই লিখেছেন। তাঁরা মানচিত্র এবং ভৌগলিক গ্রন্থগুলোর সংকলন করেছেন। তারপরও তাদের কোনো কীর্তিই পিরি রেইসের ‘গ্রেট বুক অফ দ্য সি’(১৫২৬)এর সমতুল্য হতে পারেনি।

বেয়ার বিনা দ্বিধায় তুলে ধরেন যে এককভাবে ইউরোপের আবিষ্কারের যুগ হিসেবে সে সময়ের কথা আজকের যুগে বলা হয় সে সময়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিল অটোম্যান বা উসমানিয়রা। উসমানিয়দের সে সময়কার অভিযানগুলোই পরবর্তী তিন শতক ধরে পাশ্চাত্যকে উপনিবেশিক শক্তি হয়ে ওঠার ভিত্তি যুগিয়েছে। তিনি আরো বলেন, ১৬ শতকের প্রথম দিকে মিশর জয় করে উসমানিয়রা। এরপরই তারা ভারত মহাসাগরে একটি সামুদ্রিকশক্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ভারত মহাসাগরে তারা পর্তুগিজদের সঙ্গে নৌযুদ্ধ করেছে। এমনকি, মুঘলরা ভারতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে অল্প সময়ের জন্য ভারতীয় বন্দর সুরাট এবং দিউ করতলগত করে নেয় উসমানিয়রা।

"সামুদ্রিক সাপের মতো গতিশীল জাহাজ" দিয়ে তাঁরা নিজেদের ক্ষমতার আরো প্রমাণ দিয়েছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র পথের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তাঁরা থেকেছেন স্থির। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে,  সুলতান নিজেকে ‘দুই মহাসাগর এবং দুই মহাদেশের অধিপতি’ হিসেবে তুলে ধরতেন। একই সাথে সুলতান নিজেকে ‘সাত জলবায়ুর প্রভু’ হিসেবেও দাবি করতেন।

বসফরাস প্রণালীর ধারে উসমানিয়দের তোপকাপি প্রাসাদ যা এখন জাদুঘর

বেয়ার বেশ জোরালভাবেই দেখিয়ে দেন যে ১৫ শতকের মাঝামাঝি পর্যায় থেকে পরবর্তী ২০০ বছর কী ভাবে উসমানিয় সাম্রাজ্য ইউরেশিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তি হয়ে উঠেছিল। (তোপকাপি প্রাসাদে ঢোকার সিংহদ্বার) ‘সাব্লাইম পোর্ট’ বা ‘উচ্চ দ্বার’এর আড়াল হতে সুলতান ও তাঁর উজিররা নানা ভাষা, বর্ণ গোত্র এবং ধর্মের মানুষদের শাসন করেছেন। তাদের শাসনের আওতায় পড়েছে দুনিয়ার ভিন্ন ভিন্ন সময় অঞ্চল বা টাইম জোন। কনস্টান্টিনোপলে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোতে প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বের লাখো মানুষ। খ্রিস্টান ধর্মত্যাগী সার্বিয়ার অধিবাসী ১৬ শতকের মহামন্ত্রী বা ‘গ্র্যান্ড ওয়াজির’ মেহমেদ সোকোল্লু পাশা ছিলেন দ্বিতীয় সেলিমের জামাতা। বসফরাসের প্রাসাদ থেকেই একই সাথে ডন, ভলগা, লোহিত সাগর এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যে খালের মাধ্যমে সংযোগের পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। মালাক্কা প্রণালীকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্য নিয়ে সুমাত্রার আচে-তে একবার পাঠিয়েছিলেন গোলন্দাজ বিশেষজ্ঞদের। ভারত মহাসাগর অঞ্চলে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উস্কে দেওয়ার জন্য নিজেদের চর পাঠাতে দ্বিধা করেননি। এরপর রাশিয়ার পরিকল্পনা বানচাল করতে পোল্যান্ডে নতুন রাজাকে বসিয়েছিলেন।  "আন্দালুসিয়ায় মরিস্কো বিদ্রোহীদের পক্ষে গেরিলা ছদ্মবেশে লড়াই করার জন্য  বন্দুকধারী সেনাদের” পাঠিয়েছিলেন। ভেনিস থেকে চিত্রকলা কিনেছেন। ইউরোপের দ্রিনা নদীর ওপর ১১ খিলানের সেতু নির্মাণ করেছেন।(সেতুটি এখনো টিকে আছে)

বসনিয়ায় দ্রিনা নদীর ওপর উসমানিয়া উজির মেহমেদ পাশা নির্মিত ১১ খিলানে সেতুটি আজো আছে

রাজদরবারে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে একযোগে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন ইহুদি আমাত্যবর্গ, ভেনিসের রাষ্ট্রদূতরা এবং উসমানিয় সাম্রাজ্যের আওতাধীন গ্রিসের অভিজাত শ্রেণীর সদস্যরা।”

একই ভাবে নব নব উদ্ভাবনে মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন উসমানিয় ব্যবসায়ীরা। টমাটো ও তামাকের চাষ করেছেন তাঁরা। মসলা ও রেশমের লাভজনক এবং জনপ্রিয় ব্যবসায় নামেন । ঘড়ি এবং চশমা নির্মাণ করার পাশাপাশি কফিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করেও তোলেন তাঁরাই।

উসমানিয় সাম্রাজ্য প্রথম দিকে কখনোই অসহিষ্ণু সাম্রাজ্য ছিল না। মুসলমান শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের আওতাধীন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করেছে। খ্রিস্টান এবং ইহুদিরা জিম্মি হিসেবে পরিচিত ছিল এবং তারা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা ভোগ করত। [জিন্মি ইসলামি আইনের একটি পরিভাষা। ইসলামী রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকদের এ শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়। জিম্মির আওতায় থাকা নাগরিকদের রাষ্ট্রকে জিজিয়া কর প্রদান করতে হয়। পণ্ডিতদের মতে তারা নিজস্ব আইন কানুন পূর্ণরূপে মেনে চলতে পারবে কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কিছু বিধিনিষেধও আরোপিত হবে। মুসলিমদের উপর আরোপিত কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব জিম্মিদের পালন করতে হয় না এবং মুসলিমদের কিছু রাজনৈতিক সুবিধা জিম্মিদের উপর প্রযোজ্য হয় না। (উইকিপিডিয়া)] । তারপরও উসমানিয় সাম্রাজ্যে এক ধরণের বহু ধর্মীয় ভারসাম্য ছিল। স্পেনিশ ইতিহাসবিদরা একে বলেছেন, “কনভিভেনসিয়া” বা "একত্রে বসবাস করা।" এর সমান্তরাল কোনো শাসনব্যবস্থা খ্রিস্টধর্মে দেখা যায়নি। ক্যাথলিক রাজারা গ্রানাডা থেকে ইহুদিদের সমূলে উচ্ছেদ করলে তাদের আশ্রয়ের ছাদ মেলে উসমানিয় সাম্রাজ্যে। উসমানিয় সাম্রাজ্যের আওতাধীন গ্রিসের উত্তরপশ্চিমাঞ্চলীয় বন্দর নগরী স্যালোনিকায় দ্রুত সংখ্যাগুরু হয়ে ওঠেন ইহুদিরা।

বেয়ার তার বইতে আরো লিখেছেন, “উসমানিয়দের সহিষ্ণুতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন, বৈচিত্র্যকে মেনে নেওয়া থেকে থেকে সরে দাঁড়ালেন।...সহনশীলতার স্থান দখল করে নিলো জাতিগত নির্মূল তৎপরতা এবং গণহত্যা।” আর উসমানিয় সাম্রাজ্য অবিলম্বে ভেঙে পড়তে শুরু করল। বুলগেরিয়া থেকে গ্রিস পর্যন্ত প্রবল জলোচ্ছ্বাসের মতো ফুঁসে উঠল জাতীয়তাবাদীর প্রচণ্ড ঢেউ। বহু-জাতিগত বৈচিত্র্যকে বিদায় দিয়ে একক-জাতিগত ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ঘটল অভ্যুদয় । ১৯১৫-১৬ সালে আর্মেনিয়ান বিরোধী ভয়ঙ্কর গণহত্যার মধ্য দিয়ে তুরস্কের শেষ সুলতানের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগের ঘনঘটায় অন্ধকার নামল। অতঃপর তুর্কি ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার সে সময়ে ১৫ লাখ আর্মেনিয়ানকে অনাহারে, পিটিয়ে বা বেয়নেটের আঘাতে হত্যা করা হলো। এই গণহত্যার ঘটনা হিটলারকে প্রেরণা  যুগিয়েছে বলেও দাবি করা হয়। এ ঘটনার পরিণামে আনাতোলিয়ার গ্রিকরা চলে গেল গ্রিসে।  ইহুদিরা পাড়ি জমাল ফিলিস্তিনে। আর জানে বেঁচে যাওয়া আর্মেনিয়ানরা সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র আর্মেনিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেল।

তবে তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নব্য-উসমানিয়বাদের সাথে যোগ হওয়া নেটফ্লিক্সের উসমানিয়দের নিয়ে মহা-ধারাবাহিক নাটক (মেগা-ড্রামা সিরিজ) ‘এরতুগ্রুল’তুর্কীদের সামনে তাদের সোনালী অতীতকে নতুনভাবে নিয়ে এসেছে। অথচ কামাল আতাতুর্কের শেখানো বুলির বাইরে পা বাড়াতে তুর্কিরা ভুলেই গিয়েছিল। আতাতুর্কের সুরে সুরে মিলিয়ে তারাও ভাবতে শিখেছিল, উসমানিয়রা ছিল ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ।’ সেই ভাবনা থেকে এখন তারা সরে আসছে।

তুর্কী ড্রামা সিরিজ এরতুগ্রুলের একটি প্রোমো- বিবিসি

উসমানিয় তুরস্ককে নিয়ে হাতে গোনা জনাকয়েক পশ্চিমী ঐতিহাসিকের জ্ঞানের প্রবল গভীরতা এতো ছিল যার জোরে কেবল তাঁরাই এ কথাকে ভুল প্রমাণ করতে পারতেন। ইতিহাসের এই ভুল ধারণা সংশোধনের পর্বে মার্ক ডেভিড বেয়ারের বই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে পারবে। অনবদ্য লেখনির আদল হিসেবে গণ্য হতে পারে অনায়াসবোধ্য কিন্তু পণ্ডিতিতে ভরপুর বইটি। বেয়ারের ‘দ্যা অটোম্যানস: খানস, সিজারস অ্যান্ড খলিফস’এর পর্যালোচনার শেষে এমনই উজ্জ্বল বাক্যাবলী প্রয়োগে দ্বিধাহীন ছিলেন উইলিয়াম ড্যালরিম্পল।

 [ফাইনান্সিয়াল টাইমস অবলম্বনে]

[email protected]

আরো পড়ুন:

ইউরোপের সংস্কৃতি বিনির্মাণের শিকড়ে রয়েছে উসমানিয়া সাম্রাজ্য

Share if you like

Filter By Topic