Loading...

নীরবতা যখন সর্বোচ্চ উত্তর

| Updated: May 15, 2021 15:08:46


নীরবতা যখন সর্বোচ্চ উত্তর

“ও মানুষ, মানুষ, দুডো চোক আর দুডো কান, দেকপা আর শোনবা, এট্টা মুক তো, কথা কম কবা”—গীতিকার গুরুপদ গুপ্তের লেখা গানের চরণ। কথাগুলোর প্রাসঙ্গিক মেজাজ নিয়ে সংশয় থাকার কথা নয়। কারণ, অনেক কিছু বলার চাইতে খুব কম বলা বা নীরবতার মতো শক্তিশালী কিছু সবসময়ই আমাদেয় অগ্রগতি এনে দেয়।

তবু, মানুষ হয়তো এমনই এক আশ্চর্য প্রজাতি, যারা কিনা সবকিছু জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও; উপেক্ষার জলে জীবন ভিজিয়ে, পার করে দেয় সব আয়ু। আমাদের আজকের আলোচনায় মূলত, নীরবতা বা কম কথা বলার মাহাত্ম্য বয়ান করব।

যেকোনো সম্পর্কের মধ্যে একে অপরের কথা শোনা একটি মূল্যবান বিষয়। একতরফা বলে যাওয়া, কখনোই একটি ভালো সম্পর্কে সুন্দর কিছু বয়ে আনে না। আসলে উভয়েই যখন শোনার ব্যাপারে মনোযোগী হয়, এবং পরিমিত পরিমাণে উত্তর দেয়, তখন সম্পর্কে ভালো বন্ধুত্ব সৃষ্টির পাশাপাশি, বিশ্বাসের দিকটিও বেশ মজবুত হয়।

অনেকসময় দেখা যায়, একটি খুব ভালো কথাও তার সম্পূর্ণ আবেদন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। কেন এমন হয়? এর পেছনে থাকা অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে: একই কথা বারবার বলা। যখন কোনো কথা বারবার উচ্চারিত হয়, তখন তা হাজার গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেমন যেন অদরকারি হয়ে পড়ে। তাই, একটি কথাকে অলংকৃত করতে, সবসময়ই তার উচ্চারণ অল্প হওয়া দরকার।

জীবনের নানামুখী প্রয়োজনে নানাবিধ প্রস্তাবের মুখোমুখি আমরা প্রায়ই হয়ে থাকি। কারো কোনো প্রস্তাবে, চট করে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ উচ্চারণ সবসময়ই আমাদের নিজস্বতাকে পিছিয়ে দেয়। মূলত, প্রতিটি প্রস্তাবে তাৎক্ষণিক নীরবতা, অর্থাৎ ভেবেচিন্তে তারপর উত্তর দেয়া একজন ব্যক্তিকে আরও বেশি সঠিক ও উপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে খুব বেশি সাহায্য করে।

কেউ কেউ কথা বলে, কারণ তার বলা উচিত। আবার কেউ কেউ বলে, কারণ সে বলতে চায়। এই দুটো বাক্যের ব্যবধান বুঝতে না পেরে, অধিকাংশ সময়ই আমরা বড়সড় ভুল করে বসি। হয়তো এমন কিছু জায়গায়, শুধুমাত্র কথা বলতে চাই বলেই এমন কিছু বলে ফেলি, যা প্রেক্ষাপটের সাথে মোটেও মানানসই নয়।

ফলে, সে স্থানে নিজেদের অবস্থান খুব সহজেই হালকা হয়ে যায়। আবার, শুধুমাত্র বলার জন্য বলে গেলে, এমন কোনো কথাও মুখ ফসকে বেরোতে পারে, যা হয়তো নিতান্তই তুচ্ছ ও ভিত্তিহীন। সুতরাং, যদি কোনো প্রয়োজনে ‘বলা’ দরকার না হয়, তাহলে ‘শোনা’কে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে আমরা চাইলেই নিজের ব্যক্তিত্বকে আরও আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারি।

ঘর কিংবা কর্মক্ষেত্রে, যেকোনো আয়োজনে প্রয়োজন হয় কিছু পরিকল্পনার। তথাকথিত কর্তাব্যক্তি যখন সে পরিকল্পনা প্রসঙ্গে অন্যকে বলার সুযোগ করে দেন, তখন খুব সহজেই তারা ভেতর থেকে শক্তি ও সাহস পায়। ফলে, বিশেষ কোনো পন্থা ছাড়াই, অন্যের মনোবলকে চাঙ্গা করা সম্ভব হয়।

অনেকসময় আমরা কাউকে কোনো প্রশ্ন করে, পাশাপাশি নানা ধরনের এমনসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিতে শুরু করি, যার দরুন আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিও আড়াল হয়ে পড়ে। তাই, প্রশ্ন করে নীরব থাকাটাই সবচেয়ে বেশি কার্যকর উপায়। কারণ, আপনি যত তাড়াতাড়ি নীরবতার মাধ্যমে আপনার অপেক্ষা জাহির করবেন, ঠিক তত জলদি কাঙ্ক্ষিত উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।
দিনশেষে নিজেকে খুঁজে পাওয়া ছাড়া মানুষ আসলে আর কিছুই খুঁজে পায় না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কার্যকর পন্থা হচ্ছে—‘নীরবতা’। কেউ যখন নিজেকে নীরবতার চাদরে আড়াল করে রাখে, তখন খুব সহজেই তার নিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। ফলে, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন কাজটি নিমেষেই সহজ হয়ে পড়ে।

মানবজীবনে দর্শনের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, জীবনের চলার পথে যা সবসময়ই কাজে লাগে। কিন্তু সবার দৃষ্টিভঙ্গি বা দর্শনের শক্তিমত্তা সমান হয় না। আর তা না হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হতে পারে— নীরবতার ঘাটতি। কেউ যখন খুব নিশ্চুপ হয়ে কোনোকিছু দেখে, তখন সে যা খুঁজে পায়, খুব কোলাহলে তা না-ও পেতে পারে। তাই, দর্শন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিটি মানুষেরই নীরবতার সান্নিধ্যে যাওয়া খুব দরকার।

ভালো থাকা না থাকা নিয়ে হাজারো যুক্তি বাজারে আছে। তবে, জীবনের খুব গভীরে প্রবেশ করলে হয়তো আমরা সবাই-ই দেখতে পাব: নীরবতার আশ্রয় ছাড়া কেউই আমরা নিজেদের একদণ্ড বিশ্রাম দিতে পারি না। তাই কোলাহলে ভরা ব্যস্ত জীবনে নিজের মন ও শরীরকে বিশ্রাম দিতে একটি নির্দিষ্ট সময় নীরব থেকে পরবর্তী দিনের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করাতে নিহিত থাকে কাঙ্খিত স্বস্তি।

সঞ্জয় দত্ত বর্তমানে ইংরেজি ভাষা  সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic