Loading...

নতুন যুগে বাংলাদেশের জন্য নতুন ঝুঁকি

| Updated: March 03, 2021 10:30:18


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ’-এর জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে থেকে গ্রহণ করেন। ছবি: পিআইডি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে ‘স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ’-এর জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে থেকে গ্রহণ করেন। ছবি: পিআইডি

২০২৬ সাল নাগাদ বিশ্ব দরবারে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটার ফলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, কেননা ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে।

স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি পরবর্তীকালে সম্ভাব্য প্রধান বাধা হতে পারে দেশের উচ্চ শুল্ক বৃদ্ধি রোধ, শিল্প-কারখানার দৈন্যদশার পাশাপাশি রপ্তানি ক্ষেত্রের পরিধি হ্রাস ইত্যাদি।

গত শনিবার দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা তাদের পর্যালোচনার আলোকে এই অভিমত জানিয়েছেন।

প্রথমত ২০১৮ এবং দ্বিতীয়ত ২০২১ সালের জরিপ অনুযায়ী নির্ধারিত তিনটি শর্ত মেনে চলার জন্য দ্য ইউনাইটেড ন্যাশনস কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি শনিবার সকালে বাংলাদেশকে ‘স্বল্পোন্নত দেশ নয়’বলে সুপারিশ করেছে।

২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ছাড়াও নেপাল ও গণতান্ত্রিক গণপ্রজাতন্ত্রী লাওস-এর উন্নয়ন কাজের জন্য স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ ঘটবে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা স্থিতাবস্থায় থাকলেও শিল্প কারখানার অবস্থা খুবই নাজুক।

“ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে বলতে হয়, ২০২৬ সালের পরবর্তী সময়টাতে টিকে থাকার জন্য আমাদের শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর যে পরিমাণ সক্ষমতা প্রয়োজন, তা বর্তমানে নেই। আমরা এই বিষয়গুলো নিয়ে ২০১৭ থেকে আলোকপাত করলেও সরকার ও কলকারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।”

বিগত চার-পাঁচ বছর থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য কাজ করে গেলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, আসিয়ান বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যক্ষেত্রে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কোনো প্রকার আলোচনা করা হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।

দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে ডক্টর মনসুর বলেন, “আপনারা লক্ষ করলে দেখবেন, বাংলাদেশে গড় শুল্ক হার শতকরা ২৭ ভাগ, যেখানে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোতে এ হার শতকরা ৪.৭ ভাগ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ যদি পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে, তাহলে তারা এত উচ্চ শুল্ক হারের কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশের সাথে কথা বলতে কতটুকু আগ্রহী হবে সে ব্যাপারে আমি যথেষ্ট সন্দিহান।”

২০২৬ সালের পর আসন্ন জটিলতা মোকাবেলায় একদম শুরু থেকেই বহুমুখী পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন দেশের এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর সেলিম রায়হান দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসকে বলেন, ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ ঘোষিত হওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য বেশ কিছু ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা ঘটবে।

তিনি আরো বলেন,“স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে এতদিন শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা পেয়ে থাকলেও উত্তরণের পর এই সুবিধা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাওয়ার কারণে বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ কমে যাবে।”

তবে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবার যেসব সুবিধা রয়েছে, তার অধিকাংশই কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করতে হবে।

কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করে ডক্টর রায়হান বলেন, বাংলাদেশের উত্তরণের পরপরই সম্ভাব্য সব সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে উঠবে এবং এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য আগামী পাঁচ বছর নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

এই অর্থনীতিবিদ জানান, আসন্ন দিনগুলোতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে সকলকে অসামান্য অবদান রাখতে হবে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর রায়হান বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের ফলে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে পারবে।

প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি আয় কমে যাবে প্রায় ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার।

পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনমিকস ডিভিশন-এর নথিপত্র অনুযায়ী, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনের মতো দেশগুলোতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

উত্তরণের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক গতিশীল সাধারণ ভারসাম্য মডেল থেকে সিমুলেশন ফলাফল ভিত্তিক পরিকল্পনায় জানা যায়, “২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত এবং চীনের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি হ্রাসের প্রভাব বছরে মোট রপ্তানির ১১ শতাংশ বা ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ হতে পারে।

“যদিও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে উত্তরণ বিদেশি বিনিয়োগগুলোকে সরাসরি আকৃষ্ট করে দেশের ভাবমূর্তি এবং অবস্থান উন্নত করবে, তবে বেশ কিছু ঝুঁকি থেকেই যায়।”

স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে, বাংলাদেশসহ আরো ৪৮টি দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রেফারেন্সেস (জিএসপি)-এর অধীনে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা ভোগ করে আসছে।

বাংলাদেশ পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি ডক্টর রুবানা হক জানান, “এ উত্তরণ আমাদের জন্য এক বিশাল জাতীয় গৌরব বয়ে এনেছে, তবে এটি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও করতে পারে।”

তিনি আরো বলেন, যেহেতু সরকারের বর্তমান ভর্তুকি কর্মসূচির ধারাবাহিকতা পরবর্তী উন্নয়নশীল যুগে চলমান নাও থাকতে পারে, এতে করে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতা প্রভাবিত হতে পারে।

“বাংলাদেশের কৌশলগত প্রবৃদ্ধি পরিকল্পনার জন্য একটি অসুবিধা হচ্ছে পোশাকশিল্পের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক বৈচিত্র্যের অভাব, বিশেষত এমন একটি অবস্থায়, যেখানে সিংহভাগ উপার্জন পোশাকশিল্পের বাজার প্রবেশাধিকারের উপর নির্ভর করে।”

তিনি এও বলেন, “বুনন এবং সুতি ছাড়া অন্য বস্ত্রের ক্ষেত্রে পশ্চাৎ-সংযোগ শিল্পের (ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ) অভাব পোশাকশিল্পের জন্য প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে ।

“শিল্প দক্ষতা বৃদ্ধি করতে প্রযুক্তি, উদ্ভাবন এবং মূলধনের প্রবেশাধিকারে জোর দিতে হবে, যাতে পণ্য বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে সুযোগ তৈরি করা যায় এবং মূল্য শৃঙ্খলের ধাপ আরো বৃদ্ধি করা যায়।

“তৈরি পোশাক শিল্প এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাজারের উপর পূর্ণ মনোযোগে এবং কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যের সম্ভাব্য তাৎপর্যের ভিত্তিতে” ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশের অন্তত আরো ৭ থেকে ১০ বছর একইরকম সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষত চলমান পরিকল্পনাগুলোর অগ্রগতির জন্য।

ডক্টর হক বলেন, “ইউরোপীয় কমিশনের সাথে জিএসপি প্লাস প্রকল্পের ৭.৪ শতাংশ আমদানি প্রান্তিক মানদণ্ড সম্পর্কিত আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমানে ২০২৩ সালের জিএসপি প্রকল্প পর্যালোচনা করছে, যা শীঘ্রই চূড়ান্ত করা হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি’র আওতাধীন আমদানি থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল আমদানির জন্য প্রান্তিক মানদণ্ড ঠিক করতে আমরা যদি সফলভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে তদবির করতে পারি, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।

তিনি পরামর্শ দেন, একইসঙ্গে বাংলাদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য সম্ভাব্য ও উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য অংশীদারদের সাথে দ্বিপাক্ষিক এফটিএ আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রয়োজন।

ডক্টর হক বলেন, সমন্বিত উন্নতি অর্জন লক্ষ্যে কৌশলগত পদ্ধতির মাধ্যমে টেকসই অগ্রগতির জন্য একটি নীতি নির্ধারণ (যেমন, বিনিয়োগ, ভর্তুকি ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা) আবশ্যক।

Share if you like

Filter By Topic