ব্যতিক্রমী এক শত্রুর মুখোমুখি পুরো বিশ্ব। স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় মেঘের ঘনঘটা। অস্ত্রের ঝনঝনানি, বিত্তের চোখরাঙানি অথবা পারমাণবিক হুমকি যেন এই শত্রুর কাছে নিতান্তই মামুলি। মানুষ কী অসহায়, কী সামান্য— তা বোঝার অন্যতম এক অধ্যায়ের নাম হয়তো কোভিড-১৯।
বাংলাদেশে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের মার্চ মাসে। তারপর থেকে রাস্তা, রেস্তোরাঁ কিংবা স্বভাবতই যেখানে মানুষের থাকার কথা ছিল, সেখানে আসর জমিয়েছে শূন্যতা। তবু যে যেভাবে পারছে, বাঁচতে-বাঁচাতে লড়ছে। আমরা আমাদের আজকের এ লেখায়, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষদের জীবনপাড়ায় গিয়ে খোঁজ নেবো, বসবো তাঁদের অভিজ্ঞতার বারান্দায়। শুনবো, মহামারির এই দিনগুলোতে তাদের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রামের কথা।
কোভিড প্রসঙ্গে জানতে প্রথমেই যাওয়া হয়েছিল সমাজকর্মী ও স্কুল শিক্ষিকা হৃদিতা তাহসিনের কাছে। তার ব্যক্তিগত অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে তিনি জানান, “কোভিডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত আমাদের মানসিক দুনিয়া। আমরা যারা বেসরকারি সেক্টরে কাজ করি, তাদের অনেকেই আজ চাকরিচ্যুত। কিংবা, খাতায় হয়তো নাম আছে, কিন্তু পকেটে ঢুকছে না বেতন। ফলে, আর্থিক অবস্থা, স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নিদারুণ বাস্তবতার মুখোমুখি আজ আমরা।”
একজন শিক্ষিকা হিসেবে বর্তমানে অনলাইনে পাঠদানের ব্যাপারটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভার্চুয়াল পাঠদান পদ্ধতি বহির্বিশ্বে আরও আগে থেকেই যাত্রা শুরু করে। আমাদের দেশে যদিও তা নতুন, তবে অবশ্যই বিষয়টি প্রশংসার দাবি রাখে। অবশ্য সর্বস্তরে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু, ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি নিয়ে যথেষ্ট কাজ করার জায়গা রয়েছে।”
ক্লাস চলাকালে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, “অনেকসময় দেখা যায়, বাচ্চারা ইন্টারনেট খোলা রেখে ক্লাস না করে ভিন্ন কিছু করছে। কিন্তু, পরিবারের কাউকেই সে সম্পর্কে যথেষ্ট দায়িত্বশীল আচরণ করতে দেখা যায়নি। পারিবারিক সচেতনতার বিষয়টি নিয়েও আমাদের ভাববার দরকার আছে। আপনার শিশুটি কী করছে না করছে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালনের জায়গা আসলে পরিবারের।”
সৃজনশীলতার বিষয়ে তিনি বলেন, “মহামারি সময়ে সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, নিজেদের সৃজন ক্ষমতা সম্পর্কে জানা। আগে নিজেদের সময় দেয়ার সময়টুকু আমাদের ছিল না, কিন্তু এখন অনেকেই তার ভেতরগত গুণাবলি সম্পর্কে জানছে, প্রকাশ করছে।”
আইনপাড়ায় ঢুঁ মারতে গিয়ে আলাপ হলো উম্মে সালিক রুমাইয়া’র কাছে। পেশায় তিনি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন।
কোভিডকালে তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মাস্ক পরিধান করলে কোভিডের মতো অসুখটি থেকে আমরা অনেকটাই দূরে থাকতে পারতাম, কিন্তু অভ্যস্ততার অভাব কিংবা ইচ্ছে করে অনেকে মাস্ক পরিধান করে না। যার খেসারত আমরা দিচ্ছি।” এছাড়াও তিনি সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থান বা জীবনমান সম্পর্কে মতপ্রকাশ করেন, “অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই, দিনমজুর মানুষগুলো ভালো নেই। এর জন্য যথেষ্ট স্বচ্ছ পরিকল্পনা প্রয়োজন, শুধু সরকার নয় সমাজের বিত্তশালীদেরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা দরকার।”
এবারে চোখ ফেরানো যাক বিনোদন পাড়ায়। মহামারির এই সময়ে প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা সহিদ উন নবীর অভিজ্ঞতা বেশ পীড়াদায়ক। কোভিডে মাস্ক ব্যবসায় দালালদের কার্যকলাপ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বেশ ব্যথাতুর বয়ান ছিল তার মুখে। তবে আশা জাগানিয়া কিছু কথাও তিনি বলেন, যা অন্ধকার সময়ে আলোর দিশারী হয়ে থাকছে- “অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কাজে আমি মুগ্ধ হয়েছি। বিশেষ করে যখন দেখি, তরুণরাই এসব কর্মে বেশি উৎসাহ দেখায়, তখন সত্যিই বুকে আশা জাগে। এবং, তরুণরাই যে আমাদের মূল শক্তি, বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়।”
মানবিক সম্পর্কের জায়গা নিয়েও তিনি অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন, “সারাদিন কাজ করে যখন বাড়ি ফিরতাম, গোছালো ঘরদোর দেখে মনে হতো, এ আর কঠিন কী? কিন্তু, এখন বাসায় থাকার বদৌলতে দেখতে পাচ্ছি, কাজগুলো কতটা কঠিন ও শ্রমসাপেক্ষ। ফলে, গৃহপরিচারিকা ও সংসার সামলানোর দায়িত্বে থাকা মানুষগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ছে।”
মহামারি থেকে ব্যক্তিগত সাবধানতা নিয়ে তাঁর মতামত হলো, “আর্থিক সঞ্চয় নিয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার। আর বিশ্বাস করা দরকার, দুর্দিনে কেউ কারো পাশে থাকে না, যদি থাকে, তবে তা সংখ্যায় যৎসামান্য।”
সবশেষে আমরা গিয়েছিলাম, চা পাড়ায়। পেশায় চা বিক্রেতা গফুর আলীর কাছে এই দুঃসময়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে, ছলছল দৃষ্টিতে তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকেন। তারপর বলেন, “অসুখের যন্ত্রণার চাইতে ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি তীব্র। কোভিডের কারণে মানুষের আনাগোনা কম, ফলে বিক্রিও কম। রাত করে বাড়ি ফিরি, যেন তার আগেই স্ত্রী কারো কাছ থেকে কিছু খাবার নিয়ে বাচ্চাদের খাওয়ায়।”
মহামারিতে সহায়তার প্রশ্নে তিনি বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, “টেলিভিশনে দেখি, কত কী আমাদের জন্য দেয়া হয়, এই খবর শুধু টেলিভিশন জানে, আমরা তো জানি না!” কোভিডে বিধিনিষেধ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, “এতকিছু বুঝি না, খাইতে চাই, বাঁচতে চাই। নিষেধ দেয়ার আগে, নিষেধ মানার শক্তি আগে দেন।”
সব পাড়া ঘুরে, নিজ পাড়ায় চোখ রেখে দেখলাম, কতটাই না বদলে গেছে জীবন! বহুদিন বসি না চা আসরে, সপ্তাহ ঘুরে আমাদের সে আনন্দময় শুক্রবারেও নেই আর আলাদা রোমাঞ্চ। তবু আশা রাখি, বুকে আঁকি সুস্থ পৃথিবীর মুখ, অদূরেই হয়তো বলে ওঠা যাবে— “বন্ধু কী খবর বল, কতদিন দেখা হয়নি!”
সঞ্জয় দত্ত বর্তমানে ইংরেজি ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন।