Loading...

প্রবৃদ্ধির গল্পের অদেখা উন্নয়ন

| Updated: March 01, 2021 09:38:30


প্রবৃদ্ধির গল্পের অদেখা উন্নয়ন

বাংলাদেশে কখনই ইউরোপীয় ‘সভ্য’ দেশগুলোর মতো অন্য দেশে উপনিবেশ গড়তে যায়নি কিংবা অন্যের সম্পদ লুট করতে বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতায় নামেনি।

শ্রমিকের রক্ত পানি করা পরিশ্রম, প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশের মাটিতে নিরন্তর কাজ করে যাওয়া, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য সাধারণ মানুষের সংগ্রাম করে যাওয়া, অপরিসীম ধৈর্য ও প্রানোচ্ছলতার বিনিময়ে বাংলাদেশ আজকের এই উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছে।

কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল উপনিবেশ-উত্তর আমলে শক্তিধর চক্রগুলো চতুর কৌশলে লুট করেছে। এই ধড়িবাজ মহল সব সময় এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যে, দুর্নীতি ও উন্নয়ন মাসতুতো ভাই। অথচ এই দুর্নীতি ও অসাম্য বাংলাদেশের অগ্রগতি অর্জনের সবচেয়ে বড় বাধা।

উচ্চ কর আহরণ এবং বড় ধরনের সমাজকল্যাণমূলক খাতে ব্যয়ের মতো সম্পদ পুনর্বণ্টণ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ক্ষমতাশালী শ্রেনিকে সম্পদের পাহাড় গড়তে দেওয়াকে ‘জাতীয় উন্নয়ন’ বলা দুরস্ত হবে কিনা রাজনৈতিকভাবে তার জবাব আসতে হবে।

এ কথা অবশ্যই ঠিক, একটি দেশ কতটা এগোচ্ছে তা পরিবীক্ষণের অত্যন্ত কার্যকর মাপকাঠি হিসেবে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধির ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

যাঁরা জিডিপির হিসাব বোঝেন না, তাঁদের জন্য বাংলাদেশের জিডিপির রেকর্ড প্রবৃদ্ধি যখন ৬ শতাংশ, তারপর ৭ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যায় তখন তাদের জন্য তা বিভ্রান্তিকর হয়ে পড়ে। তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের মনে যে প্রশ্ন আসে, সেটি হলো, এই প্রবৃদ্ধি আসলে হচ্ছেটা কার?

একজন সাধারণ নাগরিক ভালো করেই জানেন, একটি সরকারি অফিস থেকে তাঁর পাওনা টাকা তুলতে হলে কী জিনিস দরকার হয়। নাগরিক জীবনে যানজট নিত্যকার বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকাশ ছেয়ে ফেলা ধুলোরাশি ও দম আটকানো কালো ঘন ধোঁয়ার ভয়াল আস্তরণ এখন উন্নয়নের অবশ্যম্ভাবী অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে দেশের মানুষের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার দুঃসাহসিক অভিযাত্রা অথবা বলকান অঞ্চলের দেশগুলোতে আটকা পড়ে শরণার্থী ক্যাম্পে মানবেতরভাবে তাঁদের দিন কাটানো দেখেই দেশের কর্মসংস্থান বাজারের অবস্থা আন্দাজ করা যায়। কিছু অনানুষ্ঠানিক কর্মী কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা ছাড়াই কিছু ‘ছুটা কাজ’ জুটিয়ে কোনো রকম চলছেন। এক সময় সামাজিক পরিবর্তন আনা ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা আধুনিক নতুন বাজার ব্যবস্থার সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

উন্নয়ন প্রোপাগান্ডা ইতিমধ্যেই জনগণের চর্বিতচর্বনসুলভ ভাষ্যে পরিণত হয়েছে। বারবার উন্নয়নের গান বাজানো হলেও প্রশাসনিক কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না।

প্রোপাগান্ডার ডামাডোলে এই জনতা ডিজিটাল পরিসরে গ্রাহক হিসেবে যতটা ভূমিকা রাখে উৎপাদক হিসেবে ততটাই কম ভূমিকা রাখে।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, একটি ব্যবসায়ী শ্রেণি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলে ফেঁপে ওঠার পর লাখ লাখ ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের সঞ্চয়ের টাকায় চলা ব্যাংকিং খাত থেকে লাভের গুড় খেয়ে ফেলছে এবং এই প্রক্রিয়ায় বিশাল বিশাল পুঁজিপতিদের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়া নিশ্চিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মোড় পরিবর্তন সম্পর্কে সম্প্রতি তিনি বলেন, একুশ শতকে স্বয়ম্ভূ পুঁজিবাদী শক্তি গোটা রাষ্ট্রক্ষমতাকে নিজেদের জন্য ব্যবহারের ক্ষমতা রাখে।’

এছাড়াও উন্নয়নের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব ধরনের কাজের বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা এমন একটি উন্মাদনাকর অবস্থায় চলে গেছে যে মানসম্মত শিক্ষা এবং কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মতো জরুরি বিষয় সরকারি নীতির অগ্রাধিকারের মধ্যে দৃশ্যমান হচ্ছে না।

প্রকল্পকেন্দ্রিক নায়করা এটি খেয়াল করতে ব্যর্থ হচ্ছেন যে, এই আত্মসন্তুষ্টি তাদের সেই ইতিহাস বিরোধী প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারে: গত দুই তিন দশকে যদি দেশের সম্পদ আত্মসাৎ না হতো বা রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করা না হতো তাহলে দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের গল্প আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত?

সাম্প্রতিক ইতিহাস আমাদের দেখাচ্ছে, ১৯৯০ এর দশক এবং ২০১০ এর দশক পরস্পর বিপরীতমুখী গতিধারায় প্রবাহিত হয়েছে। প্রথমোক্ত দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে সমাজের সর্বশ্রেণির মানুষের উন্নয়ন প্রচেষ্টা হিসেবে ধরা যায় এবং এর সুফল সবাই পেয়েছে বলে ধরা যায়। আর শেষোক্ত দশকের উন্নয়ন শুধু আশীর্বাদপুষ্ট পক্ষের জন্য উৎসর্গীকৃত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শেষমেশ সরকারের আশীর্বাদধন্য গোষ্ঠীবদ্ধ পুঁজির কারণে উদ্যোক্তাভিত্তিক পুঁজিকে হটিয়ে দিয়েছে।’

শুধুমাত্র সমৃদ্ধির মালিকানাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়, বরং সেই সমৃদ্ধির সঙ্গে ‘নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠদের’ যুক্ত করাও আসলে প্রধান ইস্যু। দেশের প্রবৃদ্ধির নতুন ধাপে এই ইস্যুকে উপেক্ষা বা অবহেলা করার সুযোগ নেই।

ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, অর্থনৈতিক অসাম্য উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘ধনীরা যদি যথাযথভাবে কর না দেন তাহলে সামাজিক সুরক্ষা, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে কোত্থেকে?’

সমতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠায় যদি সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা না যায় তাহলে উন্নয়নযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।

দৃশ্যমান অবকাঠামোকে অবিনশ্বর কীর্তি ও অর্জন হিসেবে দেখার যে উন্মাদনা চলছে তার ডামাডোলে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রধান পরিচালক প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে নজর দিতে পারছেন না। এর ফলে মানব উন্নয়নের বিষয়টি এখন শুধু ইউএনডিপি'র বার্ষিক প্রতিবেদনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

[email protected]

Share if you like

Filter By Topic